Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪,

মূলধন ঘাটতি লুকানোর কৌশল

রেদওয়ানুল হক

ডিসেম্বর ২৫, ২০২২, ০১:০১ এএম


মূলধন ঘাটতি লুকানোর কৌশল

মূলধন ঘাটতি কম দেখাতে নানা কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ ক্ষেত্রে প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে ১৪টি ব্যাংক। এছাড়া অনাদায়ি সুদ দেখানো হচ্ছে আয় খাতে।

একইসঙ্গে খেলাপি কম দেখাতে বিশেষ ছাড় দেয়া হচ্ছে। ফলে কিস্তির আংশিক পরিশোধ করেও নিয়মিত থাকছে ঋণ। এই সুযোগে প্রভিশনও কম রাখতে হচ্ছে। বাস্তবে ব্যাংকগুলোকে বাইরে থেকে ভালো দেখানোর জন্য এমন কৌশল নেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ভেতরের দুর্বলতা যাতে বেড় হয়ে না আসে তাই কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এমন কার্যকলাপ বাস্তবতা বিবর্জিত ও আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে চলতি বছরও ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর ফলে একজন ঋণগ্রহীতা যে পরিমাণ কিস্তি পরিশোধ করার কথা, তার আংশিক দিয়েও নিয়মিত থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। আর খেলাপি না হওয়ায় ব্যাংকগুলোকেও নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হচ্ছে কম পরিমাণে।

একইসঙ্গে পুরো ঋণের বিপরীতে সুদ আয় খাতে স্থানান্তরের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অবশ্য সুবিধা পাওয়া সিএমএসএমই ঋণের বিপরীতে ১ শতাংশ এবং অন্য ক্ষেত্রে ২ শতাংশ সাধারণ সঞ্চিতি বা জেনারেল প্রভিশন হিসেবে আলাদা রাখার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া এমন সুবিধা কোনো বিচারেই ঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বাইরে থেকে স্বাস্থ্যবান মনে হলেও ভেতরের অবস্থা আড়াল থাকবে। যা অর্থনীতির জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে। একই সঙ্গে যে আয়ের ওপর ভিত্তি করে লভ্যাংশ দেয়া হবে এবং অন্যান্য সব হিসাব নিরূপণ হবে; পরবর্তীতে তা ফেরত না আসলে পুরো প্রক্রিয়াটি এলোমেলো হয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘যে টাকা আদায় হয়নি তা আয় দেখানো কোনো যুক্তিতেই সঠিক নয়। এর ফলে সত্যিকার বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্ত একেবারেই ভালো হয়নি।’

এমন সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে বাইরে থেকে ভালো দেখানোর জন্য এমন সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে ভালো ব্যাংকগুলো নিরাশ হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে যারা ভালো গ্রাহক, যত সংকটই হোক তারা টাকা দেবে। আর ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা এসব সুযোগ নেয়।’

মূলধন ঘাটতি কমাতে এমন কৌশল নেয়া হচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটি হতে পারে। কারণ যেহেতু ছাড়ের কারণে ঋণ নিয়মিত থাকছে তাই ব্যাংকগুলোকে কম প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।’

এর আগে ১৪টি ব্যাংককে প্রভিশন সংরক্ষণে এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ডেফারেল সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিমাণ প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। 

সুবিধা নেয়া ব্যাংকগুলো হলো— সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, বেসিক, এবি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, আইএফআইসি, ন্যাশনাল, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ওয়ান, সাউথ বাংলা, সাউথইস্ট ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। মূলধন ঘাটতি আড়াল করতে এসব ব্যাংক এমন সুবিধা নেয়। এখন আবার অনাদায়ি সুদ আয় খাতে দেখানোর সুযোগ পাওয়ায় বাড়তি সুবিধা পাবে ব্যাংকগুলো।

ঋণ শ্রেণিকরণে বিশেষ সুবিধা ও অনাদায়ি সুদ আয় খাতে দেখানোর সুযোগ দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান সংকট বিবেচনায় ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সুবিধা দেয়া হয়েছে। আর যেহেতু সুবিধার কারণে ঋণগুলো শ্রেণিকৃত হচ্ছে না, তাই স্বাভাবিক নিয়মেই সুদ আয় খাতে দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকি কমাতে অতিরিক্ত দুই শতাংশ জেনারেল প্রভিশন রাখতে বলা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, করোনার কারণে ২০২০ সালে এক টাকা পরিশোধ না করেও ঋণ নিয়মিত রাখার সুযোগ ছিল। আর ২০২১ সালে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তার ১৫ শতাংশ দিলে আর খেলাপি হয়নি। চলতি বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ সংক্রান্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে।

এবারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বৃহৎ শিল্পের মেয়াদি ঋণে প্রদেয় কিস্তির ৫০ শতাংশ জুনে, সেপ্টেম্বরে ৬০ এবং ডিসেম্বরে ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলে আর খেলাপি হবে না। সিএমএসএমই ও কৃষি খাতে জুন প্রান্তিকে প্রদেয় কিস্তির ২৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৩০ এবং ডিসেম্বরে ৪০ শতাংশ পরিশোধ করলে নিয়মিত থাকবে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, সুবিধা পাওয়া ঋণের সম্ভাব্য আদায় ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে ২০২২ সালে আরোপিত সুদ বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে। তবে ২০১৯ সালে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল ও ২০১৫ সালে পুনর্গঠন করা ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ নগদ আদায় ছাড়া আয় দেখানো যাবে না। আর সুবিধা পাওয়া ঋণে অতিরিক্ত ২ শতাংশ জেনারেল প্রভিশন রাখতে হবে।

সিএমএসএমই খাতের সুবিধা পাওয়া ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত ১ শতাংশ প্রভিশন রাখা যাবে। অতিরিক্ত প্রভিশন করোনার সময়ে গঠিত স্পেশাল জেনারেল প্রভিশন খাতে স্থানান্তর করতে হবে। ইতোমধ্যে সুবিধা পাওয়া কোনো ঋণ নগদ আদায়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিশোধ হলে এর আগে সংরক্ষিত জেনারেল প্রভিশন ব্যাংকের নিজস্ব বিবেচনায় আয় খাতে নেয়া যাবে।

Link copied!