Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

ডলারের বিকল্প চায় বিপিসি

মহিউদ্দিন রাব্বানি

মে ২৭, ২০২৩, ১২:৩২ এএম


ডলারের বিকল্প চায় বিপিসি

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি খাতে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটে। দেশে ধারাবাহিক ডলার সংকটে জ্বালানি আমদানিতেও ধস নামে। আমাদানির ওপর নির্ভরশীল জ্বালানি ব্যবস্থায় বিপাকে পড়ে সরকার। জ্বালানির সংস্থান বাবদ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলোর দেনা অনেক আগেই ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলারের বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করেছে। 

বিদেশি ছয় প্রতিষ্ঠানের কাছেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ৩০ কোটি ডলার দেনা। দেশে তীব্র ডলার সংকটের কারণে বিপিসি বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। যার ফলে জ্বালানি তেল পাঠানোর হুমকি দিয়েছে ওই ছয় কোম্পানি। এতে বড় চাপে পড়তে যাচ্ছে বিপিসি। জ্বালানি তেলের বকেয়া বিল পরিশোধে ডলারের বিকল্প খুঁজছে বিপিসি। প্রতিষ্ঠানটি চীনের সঙ্গে ইউয়ান ও ভারতের সঙ্গে রুপিতে বিল পরিশোধের চিন্তা করছে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বিপিসি। এর আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লেনদেনের জন্য ডলারের বিকল্প হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারে সম্মত হয়েছে রাশিয়া ও বাংলাদেশ। 

বিপিসি সূত্র বলছে, চীন থেকে আমদানি করা জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে ইউয়ান ব্যবহারে চীনকে একটি প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এক বছরের বেশি সময় ধরেই জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে নিয়মিত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না ব্যাংকে। বকেয়া বিল পরিশোধে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানির চাপও বাড়ছে দিন দিন। এ পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার-স্বল্পতার কারণে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুসারে ডলার সরবরাহ না করায় আমদানি মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে।
বিপিসি চিঠিতে বলেছে, মে থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নুমালিগড় থেকে ৫৮ হাজার টন ডিজেল কেনা হবে। একই সময়ে আইওসিএল থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টন ডিজেল এবং ৩০ হাজার টন জেট ফুয়েল (উড়োজাহাজে ব্যবহূত) কেনা হবে। 

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, ওয়ান ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এসসিবি, এইচএসবিসি আগে জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খুললেও দুই বছরের বেশি সময় ধরে তারা তা দিচ্ছে না। মাসে পাঁচ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও এক লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আনতে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র খোলার দরকার হয় বিপিসির। এর মধ্যে সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক মাসে চার থেকে পাঁচটি করে ঋণপত্র খুলছে। আর অগ্রণী ব্যাংক একটির বেশি ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না।
দেশের পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানির সংস্থান হয় আমদানির মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরকারি কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে এসব জ্বালানি আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এ আমদানি অব্যাহত রাখা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জ্বালানি তেল, কয়লা ও গ্যাস প্রাথমিক এ তিন জ্বালানি আমদানি বাবদ বিপুল বকেয়া জমেছে জোগানদাতাদের কাছে। এ দেনা শোধ করা যাচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। হিসাব করলে দেখা যায়, জ্বালানির সংস্থান বাবদ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলোর দেনা অনেক আগেই ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ছাড়িয়ে গেছে। 

বৈশ্বিক আর্থিক ও পণ্যবাজার সংক্রান্ত মার্কিন তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের বরাত দিয়ে ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে বিদেশি জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের পাওনা শোধ করতে পারছে না বিপিসি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। ১৬ মে পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপিসির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ২৯৭ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন (প্রায় ২৯ কোটি ৭৫ লাখ) ডলার। এর প্রায় পুরোটাই পাবে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক। 

জ্বালানি তেল আমদানিতে মূল্য পরিশোধের সর্বোচ্চ সময়সীমা থাকে ৩০ দিন। আগে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল জাহাজীকরণের ৮-১০ দিনের মধ্যেই মূল্য পরিশোধ করে দিত বিপিসি। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এভাবেই আমদানি অব্যাহত রাখতে পেরেছে সংস্থাটি। কিন্তু বিপিসির আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয় মার্চ থেকে। ডলার সংকটে বকেয়া জমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিপিসি জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও কথা বলেছে সংস্থাটি। যদিও এতে সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। কয়লা আমদানি বাবদও বিপুল বিল বকেয়া পড়েছে সরকারের। মার্চ পর্যন্ত পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির মূল্য বাবদ বকেয়া ছিল ২৯৮ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চলতি মাসে দুই কিস্তিতে পরিশোধ হয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার। সে অনুযায়ী, শুধু পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রেই বকেয়া আছে ২৭৮ মিলিয়ন ডলার। সামনের দিনগুলোয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু রাখতে প্রয়োজনীয় কয়লার সংস্থান হওয়া নিয়েই অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে জানিয়েছে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এ মূল্য পরিশোধ করার কথা। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি ও বকেয়ার বিষয়টি নিয়ে ১০ মে বিপিডিবিকে একটি চিঠি দেয় বিসিপিসিএল। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানি বাবদ বকেয়ার পরিমাণ মার্চ পর্যন্ত ২৯৮ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। বিপুল বকেয়ার কারণে বিসিপিসিএল ৫০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ও ডেফার্ড পেমেন্টের সুবিধা প্রদানকারী সিএমসি কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ইন্দোনেশিয়ার পিটি বায়ান রিসোর্সেস টিবিকে থেকে কয়লা সরবরাহের জন্য ঋণপত্র খুলতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

দেশে গ্যাসের স্থানীয় উত্তোলনের ৬০ শতাংশেরও বেশি আসছে মার্কিন বহুজাতিক শেভরন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বহুজাতিকটির কাছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) দেনা ছিল অন্তত ১৫০ মিলিয়ন ডলার। সূত্র অনুযায়ী, গ্যাস সরবরাহ বাবদ প্রতি মাসে শেভরনকে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে সেটিও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। শেভরনের পক্ষ থেকে মাসিক বিলের অন্তত অর্ধেক পরিশোধের কথা বলা হলেও সেটিও সম্ভব হচ্ছে না পেট্রোবাংলার পক্ষে। ফলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটির কাছে পেট্রোবাংলার দেনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শেভরনের সঙ্গে পেট্রোবাংলার চুক্তি অনুযায়ী বকেয়া পরিশোধে ৩০ দিনের বেশি বিলম্বে জরিমানাও দিতে হয়।

বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) খালিদ আহম্মেদ এ বিষয় বলেন, ‘কিছু সরবরাহকারী তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, দ্রুত বকেয়া পরিশোধ না করলে তারা সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। বিপিসি আগে কখনো এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আমরা আগে সব সময়ই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করতাম।’

বিল পরিশোধে ডলারের বিকল্প হিসেবে রুপি বা ইউয়ানের ব্যবহারের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখানে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমত দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতির বিষয় আছে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিপিসির চাহিদামতো রুপি বা ইউয়ান থাকতে হবে। সেই রুপির সঙ্গে টাকা ও ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণেরও ব্যাপার আছে। ডলার-সংকটের মধ্যে এটি হয়তো বিবেচনা করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তাদের কাছে খুব বেশি রুপি বা ইউয়ান থাকার কথা নয়। এটা দিয়ে কিছু বিল হয়তো পরিশোধ করা যাবে, কিন্তু খুব বেশি বড় বাণিজ্য করা যাবে না।’

আরএস
 

Link copied!