Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

সড়কে মৃত্যুতে বিপর্যস্ত পরিবার

মো. মাসুম বিল্লাহ

মো. মাসুম বিল্লাহ

সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩, ১১:১৭ পিএম


সড়কে মৃত্যুতে বিপর্যস্ত পরিবার

সাইফুল ইসলাম (২৩) গত ৮ সেপ্টেম্বর ভোরে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকা থেকে নিজ বাড়ি কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হন। সকাল সোয়া ৭টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভবেরচর হাইওয়ে থানা এলাকায় ট্রাকচাপায় আহত হয়ে সাইফুলের কোমড়সহ বাম পা থেঁতলে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) জরুরি বিভাগে ভর্তি করানো হলে ডাক্তারের পরামর্শে বাম পা কোমড় থেকে কেটে ফেলা হয়। তিনি দীর্ঘ ১৫ দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন— এমনটাই আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন সাইফুলের পরিবার।

শুধু সাইফুল নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় এমন অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কত পরিবার যে নিঃস্ব হয়ে গেছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানে না কেউ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরেও নেই এমন তথ্য। দুর্ঘটনায় আপনজনদের কতটা বিপর্যস্ত করে তা সাইফুলের পরিবারের মতো ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারে। দেশের সড়ক-মহাসড়কে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলেও উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিস্তারিত জানার জন্য সাইফুলের চাচা মো. নুরুল আমিনের সাথে যোগাযোগ করলে আমার সংবাদের এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা থানায় গিয়ে যোগাযোগ করে জানতে পারি পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। গাড়ি আটক করতে পারেনি। তবে গাড়ি খুঁজে পেলে কোর্টে চার্জশিট দেবে বলে জানিয়েছে।’ তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, আইমা এলপিজি ফিলিং স্টেশনের কর্মী পারভেজ ঘাতক ট্রাকের নাম্বারসহ ছবি পুলিশের কাছে দিয়েছেন। 

পরিবার সূত্রে জানা যায়, সাইফুল কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলা গাজড়া পাড়া ইউনিয়নের মো. রুহুল আমিনের ছেলে। তার বয়স যখন ১৪ বছর তখন সে ঢাকায় এসে বিভিন্ন দোকানে কাজ করে পরিবারের খরচ চালাতেন। তবে তাকে হারিয়ে দিশেহারা তার পরিবার। তারা সাইফুলের চিকিৎসা করতে গিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। বিচার চাচ্ছেন কি-না এমন প্রশ্নে সাইফুলের ভাই এ প্রতিবেদককে বলেন, আসলে এর বিচার আদৌ হয় কি-না আমার জানা নেই। তবে আমার ভাইয়ের মতো আর কাউকে যেন এভাবে জীবন দিতে না হয়।

এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত শরিফুল ইসলাম আবু সাইদ (২৫) গত বছরের ২৫ জানুয়ারি শাহ্ সিমেন্ট কোম্পানির ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে। এতে সাইদের ডান পা ও আব্দুল্লাহ আল কাফির ডান হাত পিষ্ট করে ঘাতক ট্রাক। কাফিকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) নিয়ে যায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ব্যক্তি। হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। এদিকে সাইদকে নিটোরে পাঁচদিন পর ডান পা কেটে ফেলা হয় তার। এভাবেই এক মাস তিন দিন হাসপাতালের বিছানায় কেটে যায়। এমনটাই আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে জানান সাইদ। 

সাইদ প্রতিবেদককে আরও জানান, আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলার সালথা থানায় বিভাগদি গ্রামে। চিকিৎসার খরচ বহন করে পরিবার একদম নিঃস্ব। বৃদ্ধ বাবা আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে অসুস্থ হয়ে বিছানায় আছেন। বাবার ভিটা ছাড়া কিছুই নাই। শাহ সিমেন্ট কোম্পানি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে নিহত কাফির পরিবারকে এক লাখ ও আমকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করেন সিমেন্ট কোম্পানির লোকজন। সাইদ তার আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে জানতে পারেন এক মাস হয়ে যাওয়ায় এখন আর মামলা করে লাভ হবে না। ২০২০ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া বিধিমালা প্রণয়ন করে। এতে আর্থিক তহবিল গঠনের একটা রূপরেখা তুলে ধরা হয়। তবে এখনো সেই খসড়া অনুমোদন করেনি সরকার। খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে ক্ষতিপূরণ পাবে তিন লাখ টাকা। নিহত ব্যক্তির পরিবার পাবে পাঁচ লাখ টাকা। আর্থিক তহবিলে সরকারের অনুদান ও যানবাহন মালিকের চাঁদা ছাড়াও সড়ক আইনের অধীনে আদায় করা বিভিন্ন জরিমানা, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের অনুদান, অন্য কোনো বৈধ উৎস থেকে পাওয়া অর্থ নেয়া যাবে। ধারা ৫৩ এর অধীন গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ প্রাপ্য হবেন ভুক্তভোগী ও তার পরিবার।

রোড সেফটি কোয়ালিশনের তথ্য মতে, পথচারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের সড়ক। প্রায় প্রতিদিনই তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বিআরটিএ বলছে, এ বছরের প্রথম আট মাসে তিন হাজার ৫৬২টি সড়ক দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৩১৭ জন মারা গেছেন। এতে আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ১৭২ জন। তবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হিসাব বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি করা হয় না। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে গত বছর পাঁচ হাজার ৮৯টি দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৬৩৬ জন মারা গেছেন। আর নিরাপদ সড়ক চাইয়ের হিসাবে একই সময়ে সাত হাজার ২৪টি দুর্ঘটনায় আট হাজার ১০৪ জন মারা গেছেন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরও কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার হার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় আচরণগত কারণে পাঁচটি মূল ঝুঁকি আছে। 

অতিরিক্ত গতি, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, সিটবেল্ট ব্যবহার না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো ও শিশুদের জন্য নিরাপদ আসনের অনুপস্থিতি। এসব আচরণগত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যথাযথ আইন ও নীতিমালা করা হলে সড়ক নিরাপদ হবে বলে মনে করছেন তারা। তথ্যে আরও জানা যায়, বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়কে পরিবহনের জন্য আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধিমালা। তাই নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে (সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ) নতুন আইন করা জরুরি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রায় ৪০ শতাংশ চালকেরই বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন এমন চালকদের ৩১ শতাংশ কোনো অনুমোদিত ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নেননি। ফলে চালকদের বেশিরভাগই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত নন। সড়ক-মহাসড়কে যেসব যানবাহন চলছে তার বেশিরভাগেরই ফিটনেস নেই। ফিটনেসবিহীন গাড়িও দুর্ঘটনার কারণ হয়। চালকদের মাদকাসক্তও সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ। 

সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা সড়ক ও মহাসড়কে কোনো রাস্তা ভাঙা থাকলে তাৎক্ষণিক মেরামত করি যাতে সড়কে দুর্ঘটনা না হয়। আর এ বিষয়ে বিআরটিএর ভূমিকা বেশি তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, যখন কেউ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় তার প্রথম দরকার চিকিৎসা। সে চালক কিংবা পথচারী হতে পারে। যদি চালক হয় তখন তার নিজের চিকিৎসার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। অনেক শ্রমিক সংগঠন কল্যাণ ট্রাস্ট নামে টাকা তোলে। তারা কেউই ভুক্তভোগীর চিকিৎসায় এগিয়ে আসে না। নেই বিমা ব্যবস্থার মতো কোনো স্থায়ী পদ্ধতি। সড়ক পরিবহন আইন করে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতার একটা বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই ট্রাস্টের মাধ্যমে কাউকে সাহায্য করা হয়েছে এমন নজির আমার জানা নাই। তবে জানা মতে, হাইকোর্ট ডিভিশনের অর্ডারে (রিট) দুই পরিবার সামান্য আর্থিক সুবিধা পেয়েছে। তবে রিট পর্যন্ত ভুক্তভোগীরা আসতে পারে না। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বেশিরভাগ দরিদ্র, মামলায় কখন যাবে তার আগে তার জীবন বাঁচানো জরুরি। মামলাগুলো পুলিশ বাদী হয়ে করে, সাক্ষী উপস্থাপন করা হয় না। যিনি আসামি তিনি মামলার তদবির করে বিভিন্ন উপায়ে খালাস পেয়ে যান। 

মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ আরও বলেন, সড়ক আইন-২০১৮ বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই শুধু কাগজ-কলমে। যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন দেখা যায় রুট পারমিট লাইসেন্স কিছুই ঠিক নেই। পুলিশ বা কর্তৃপক্ষ যারা আছে তারা অনিয়ম দেখেও কিছু বলে না। প্রতিদিন যতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে নামমাত্র মামলা হয়। যারা মামলা করবে তারা ভুক্তভোগীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে ফলে তারা ন্যায় বিচার ও চিকিৎসা দুটো থেকেই বঞ্চিত হয়। একটা সময় কেউ পঙ্গু বা মারাও যায়। লজ্জায় ভিক্ষাও করতে পারে না, ভিক্ষুকের চেয়েও খারাপ অবস্থায় দিনাতিপাত করে তারা। এরা কারো পক্ষ থেকেই কোনো সহযোগিতা পায় না— এটাই বাস্তব চিত্র।
 
 

Link copied!