অক্টোবর ১১, ২০২৩, ১১:১৬ পিএম
একদিকে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে টানা তিন মাস বেড়েছে রান্নার কাজে বহুল ব্যবহূত এলপিজি গ্যাসের দাম। চড়া এলপিজির বাজারে ভোক্তা কষ্টে আছে। সরকারিভাবে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না বাজারে। গ্রাহকরা প্রতি ১২ কেজির এলপিজির জন্য গুনছেন ১৬৫০ থেকে ১৭০০ টাকা। অথচ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ১২ কেজি এলপিজির দাম ১৩৬৩ টাকা। চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এলপিজির নতুন দাম বেঁধে দেয়। ১২ কেজি সিলিন্ডার ছাড়াও সাড়ে পাঁচ কেজি থেকে শুরু করে ৪৫ কেজি পর্যন্ত সব সিলিন্ডারের দামই বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫.৫ কেজির দাম বেড়ে ৬২৫ টাকা, ১২.৫ কেজি ১৪২০ টাকা, ১৫ কেজি ১৭০৪ টাকা, ১৬ কেজি ১৮১৮ টাকা, ১৮ কেজি ২০৪৫ টাকা, ২০ কেজি ২২৭২ টাকা, ২২ কেজি ২৫০০ টাকা, ২৫ কেজি ২৮৪০ টাকা, ৩০ কেজি ৩৪০৮ টাকা, ৩৩ কেজি ৩৭৪৯ টাকা, ৩৫ কেজি ৩৯৭৬ টাকা এবং ৪৫ কেজির দাম ৫১১৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম নির্ধারণের দায়িত্ব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। বিশ্ববাজার এবং স্থানীয় আর্থিক সংশ্লেষ, বাজার ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি মাসে নিয়মিত এলপিজির সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করছে জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। গত কয়েক মাস ধরে রান্না ও পরিবহনের এ জ্বালানির দাম টানা বাড়ছে। এরপরও সামপ্রতিক মাসগুলোতে বিইআরসির নির্ধারিত দামের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না রাজধানীসহ দেশের সব জেলায়। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশ চড়া দামে বোতলজাত গ্যাস কিনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে ভোক্তাপর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ১৪০ টাকা থেকে ১৪৪ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৮৪ টাকা করা হয়েছিল। তার আগে আগস্টে এলপি গ্যাসের দাম ছিল ১১৪০ টাকা। জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে ১৪১ টাকা বেশি দরে এই গ্যাস বিক্রি হয়েছে। জুলাইয়ে বিক্রি হয়েছিল ৯৯৯ টাকায়। আগস্টের আগে কয়েক মাস গ্যাসের দাম কম ছিল। তিন দফা বাড়ায় এখন চড়া দামে গ্যাস কিনতে হবে ভোক্তাদের।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় খবর নিয়ে জানা যায়, বিইআরসির বেঁধে দেয়া দামে কোথাও মিলছে না এলপি গ্যাস। গ্রাহকরা অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার যদি দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে প্রতিমাসে এলপিজির দাম ঘোষণা করার মানে হয় না। নিত্যপণ্যের বাজারে যেতেই এখন বুক কাঁপে বলে জানান যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা নরুল হক। তিনি বলেন, এর মধ্যে সরকার নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার পেলেও কিছুটা বাঁচা যেত। প্রতি বোতলে ৩০০-৪০০ টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে।
একদিকে নিত্যসব পণ্যের দাম আকাশচুম্বি। এরপর আবার বহুল ব্যবহূত এলপিজি কিনতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা রহমাত আলী নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস কিনতে পারেননি বলে জানান এ প্রতিবেদককে। বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়েই কিনতে হয়েছে তাকে। আক্ষেপ আছে, তবে অভিযোগ করতে রাজি না তিনি। বললেন, অভিযোগ করার কী আছে? এটা তো ওপেন-সিক্রেট। সরকার সবই জানে। সব জায়গায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা নিগার সুলতানা জানান, তিনি গত মাসের শুরুতে ১৪০০ টাকায় ১২ কেজির এক বোতল এলপিজি কিনেছেন। মাসের শেষে এসে সেই দাম বেড়ে হয়েছে ১৭৫০ টাকা। আবার এ মাসে কিনতে গেলে একদাম ১৮০০ টাকার নিচে দেয়া যাবে না বলে দোকানি স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, সরকারের বেঁধে দেয়া দামে দিন দিন আস্থা হারিয়ে ফেলছে জনগণ। রাজধানীর বনশ্রীর এক খুচরা এলপিজি ব্যবসায়ী জানান, ডিলারদের কাছ থেকে আমরা বিইআরসি ঘোষিত দামে কিনতে পারি না। সুতরাং আমরাও একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এর সঙ্গে প্রত্যেক বোতলের পরিবহন খরচ রয়েছে। এরপর তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, দোকান ভাড়া, কর্মচারী, আমার নিজের সংসার আছে আমার তাহলে কত বিক্রি করা উচিত?
১৩৬৩ টাকার ১২ কেজি এলপিজির দাম ১৭০০ টাকা পর্যন্ত রাখার কারণ জানতে চাইলে ডিলাররা বলছেন, দায় কোম্পানির। কোম্পানি বলছে ডিলারে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ১৮টি কোম্পানি এলপিজি গ্যাস বিক্রি করছে। কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ার অভিযোগ এনে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় দামও একটু বেশি নিতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এলসি খোলায় বড় সমস্যা। আমরা প্রতি মাসে এলসি খুলে এলপিজি আমদানি করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধারাবাহিকভাবে এলসি খোলা যাচ্ছে না। যদি মাসে দুটি এলসি খোলা হয়ে থাকে, তাহলে একটার সঙ্গে আরেকটা এলসি খোলার যে ধারাবাহিকতা সেখানে গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। সে গ্যাপের সুযোগ নিচ্ছেন ডিলার ও দোকানিরা। যখন ডিলাররা দেখেন যে এ মাসে প্রোডাক্ট কম আসছে কোম্পানি থেকে, তখন তারা টার্গেট পূরণের জন্য বেশি দামে সিলিন্ডার বিক্রি করেন। আপনি তাদের কাছে সঠিক মূল্যের হিসাব পাবেন না। আবার দোকানি যখন দেখছে সাপ্লাই কম, তারাও তখন মজুত করে দাম বাড়িয়ে ফেলে। সুতরাং সমস্যাটা সামগ্রিকভাবে তৈরি হয়। কোম্পানি যে দামে সেল করতে চায়, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে গিয়ে তার দাম বেড়ে যায়। আমরা সবসময় চেষ্টা করি নির্ধারিত মূল্যেই গ্যাস বিক্রি করতে।
এলপিজি বোতলজাত এবং বিপণনে জড়িত একটি কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিইআরসি সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করছে সর্বনিম্ন ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় নিয়ে। তাই ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বা লাভ বেশি থাকছে না। তাই পাইকারি পর্যায়ে ও খুচরা পর্যায়ে দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা যাচ্ছে না। তবে একজন ডিলার জানিয়েছেন, এলপিজি কোম্পানির গেট থেকেই তারা বেশি দামে কিনছেন। স্বাভাবিকভাবে তারা এবং খুচরা বিক্রেতারা তাই বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যবসায়ীরা যে আইন মানছেন না, তার প্রমাণ এলপিজি খাত। বাজার প্রতিযোগিতামূলক করতে নির্ধারিত দামে বিক্রি করায় আগ্রহী কোম্পানিকে নতুন করে লাইসেন্স দিতে পারে বিইআরসি।
এ প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের মূল্যায়ন ও দাবি বিবেচনায় নিয়েই এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু খুচরা বাজারে মূল্যহার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের নৈতিক সমস্যা রয়েছে। বিইআরসি এবং জেলা প্রশাসন নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি নিশ্চিত করতে এখন অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা গত মাসে কোম্পানিগুলোর সাথে মিটিং করেছি। তাদের দাবি-দাওয়া শুনেছি। সেগুলো বিবেচনায় রেখেই দাম নির্ধারণ করছি। এতে ডিলার, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন রাখা হয়েছে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আমরা মূল্যটা নির্ধারণ করছি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যেখানেই খোঁজ নিচ্ছি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারপ্রতি দাম দু-একশ টাকা বেশি নেয়ার অভিযোগ পাচ্ছি। যে কোনো মূল্যে ন্যায্য দামে এলপিজি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিইআরসি নজরদারি করছে, অপরেটরদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। দরকার হলে লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা থাকতে পারে।