Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ১১ মে, ২০২৫,

এক কাজ করে চলে না সংসার

মহিউদ্দিন রাব্বানি

নভেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:২৭ এএম


এক কাজ করে চলে না সংসার
  • ডিম, আলু ও পেঁয়াজে বেঁধে দেয়া দাম ৬০ দিনেও কার্যকর হয়নি
  • দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী চাপে চিড়েচ্যাপটা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা
  • পণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি সাধারণ মানুষের আয়
  • খাদ্যতালিকা কাটছাঁট করে বাদ দিচ্ছে আমিষ —সিপিডি

ব্যবসায়ীদের রসিদ না থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে 
—এ এইচ এম সফিকুজ্জামান মহাপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

দ্রব্যমূল্যের এমন দামে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে জনজীবনে 
—এম শামসুল আলাম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

উল্লম্ফন গতিতে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। বাজারে পণ্য কেনা যেন পকেট কাটার মহোৎসব। সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। ভাড়া বাসায় থেকে একটি চাকরি করে পরিবারের সবার মুখের হাসি ফোটাতে পারি না। এ জন্য অফিসের কাজ শেষ করে অন্য আরেকটি কাজ শুরু করেছি। এমন কথাই বলেছিলেন আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম) নামে ১৩ গ্রেডের এক সরকারি চাকরিজীবী। নানা অজুহাতে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই পাগলা ঘোড়া কোথায় গিয়ে থামবে, কে থামাবে, তা জানতে চায় সাধারণ মানুষ। মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠছে প্রতিনিয়ত। জিনিসপত্রের হুহু করে বাড়লেও বাড়েনি মানুষের আয়। 

আব্দুর রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, সকাল ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অফিস চলে। সম্প্রতি সন্ধ্যায় একটা অফিসে দু’-তিন ঘণ্টা কাজ করি। সেখান থেকে কিছু ইনকাম হয়। দুই চাকরিতে মোটামুটি মাস চলে যায়। হাসিবুর রহমান রাজধানীর বিজয়নগরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। 

আমার সংবাদের এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, যে বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। এ জন্য বাড়তি আয়ের আশায় ঋণ করে মোটরবাইক কেনেন। তিনি অফিসের আগে ও পরে বাইক শেয়ার করে প্রতিদিন ৫০০-৭০০ টাকা বাড়তি আয় করেন। 

হাসিবুর বলেন, বিকল্প আয় না থাকলে বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজার সময়ে টিকে থাকা দুঃসাধ্য। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরার প্রয়াসে গত দুই মাস আগে প্রথমবারের মতো তিনটি কৃষিপণ্য ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। এদিকে দুই মাসেও দাম কার্যকর হয়নি বাজারে। সরকারের এই বেঁধে দেয়া দামে ভোক্তা সাধারণ কোনো উপকার পেলো না। উল্টো বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সে সময়  বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এখন থেকে প্রতিটি ফার্মের ডিম ১২ টাকা, আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭) এবং দেশি পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪-৬৫ টাকা।

এর আগে তেল এবং চিনির মূল্য পাঁচ টাকা কমলেও গ্রাহক পাচ্ছে না ন্যায্য মূল্যে। এদিকে দফায় দফায় বেড়েছে চাল, আটা, ময়দা, ডাল, আদা, রসুন, মুরগি, মাছ, লবণ, মাংস ও শাক-সবজির দাম। প্রতিদিনই দাম বাড়ায় উদ্বেগে ফেলছে ক্রেতাদের। আগে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছিল, তা কমারও কোনো লক্ষণ নেই। আবার সরকারের বেঁধে দেয়া দামও মানা হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখী চাপে চিড়েচ্যাপটা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। পরিবারের ন্যূনতম আমিষের জোগানও নেই অনেক পরিবারে। 

সরকারি চাকরিজীবী সুলাইমান হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, নিত্যপণ্যে হুহু করে দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়লেও আমাদের বেতন তো আর বাড়ে না। 

এ ছাড়া তিনি বলেন, বেসরকারি কোম্পনিতে আলোচনা সাপেক্ষে বছরের যেকোনো সময়ে বেতন বৃদ্ধির সুযোগ থাকে। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বেতন বৃদ্ধির বিধান নেই। এমন পরিস্থিতিতে বাসা ভাড়া যেন কম লাগে সে জন্য তিনি থাকেন ভেতরের দিকে রাজধানীর এক প্রান্তে। 

সাদ্দাম নামে এক কর্মজীবী বলেন, মাস শেষে বেতন পাই ২২ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ২০-২২ হাজার টাকা বেতন দিয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে গেছে। বাসাভাড়া দিয়ে আর বাজার সদাই করে পুরো মাস চলা যায় না। বেতন পাওয়ার ১০-১২ দিনে মধ্যে তা শেষ হয়ে যায়। বাকি দিনগুলো ধারদেনা করে অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। গ্রামে বাবা-মা আছেন। বাড়িতে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা উল্টো আরও নিয়ে আসা লাগে। হঠাৎ করে কোনো মেহমান এলে খুবই চিন্তায় পড়তে হয়। খুবই কাটছাঁট করে হিসাব-নিকাশ করে চলতে হচ্ছে। 

রাজধানীর বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কেউ যদি মাসিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন তবে তার ছোট্ট দুই রুমের একটি বাসা ভাড়ার পেছনেই চলে যায় কম করে হলেও ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তাও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বাদ দিয়ে ভেতরের এলাকার দিকে বাসা নিতে হয়। পাশাপাশি গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলের জন্য আরও গুনতে হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। যদি সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হয় তবে এখানে আরও এক হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়। অর্থাৎ শুধু বাসা ভাড়ার পেছনেই ব্যয় হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বাকি টাকায় টেনেটুনে চলে সংসার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক গবেষণা বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগগিরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে শুধু খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। এটি ‘কমেপ্রামাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, কোনো অদৃশ্য হাত নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির করে তুলেছে। বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতাদের রসিদ ব্যবহার করতে হবে। পাকা রসিদ না থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

ভোক্তা অধিকার আদায়ে সরব কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলাম বলেন, দ্রব্যমূল্যের এমন দামে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতিতে জনগণ অসহায় হয়ে পড়েছে। এর একটি প্রভাব ইতোমধ্যে জনজীবনে পড়েছে এবং সেটি অবশ্যই আরও বাড়বে। যেমন— সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। ভোগ ব্যয় কমবে এবং ভোগ্যপণ্য কম ব্যবহার করে তারা বঞ্চিত হবে। জীবনযাত্রার মান কমে যাবে।’

 

Link copied!