নভেম্বর ২২, ২০২৩, ০৫:০২ পিএম
- ব্যবসা বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ঝুঁকি বাড়ছে
- রাজনৈতিক অস্থিরতায় দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা
- বাজারে শীতের সবজি ভরপুর, দামও চড়া
- হরতালে এক দিনে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
ন্যায্য দাম কার্যকরে দরকার বাজারে নজরদারি বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঠিক রাখা
—গোলাম রহমান সভাপতি, ক্যাব
ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি
—মাহবুবুল আলম
সভাপতি, এফবিসিসিআই
চলমান হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। করোনার অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, দেশে ডলার সংকটের পর এবার রাজনৈতিক হরতাল-অবরোধে দেশের আর্থিক খাত এক কঠিন পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের বাজারের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে ভোক্তাসাধারণ। চওড়া মূল্য হাঁকছেন বিক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারির ধকল সামলে ওঠার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এমনিতেই দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তার ওপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে হরতাল-অবরোধ শুরু হয়েছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতিকর। ব্যবসা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাই আমরা এরকম হরতাল-অবরোধ চাই না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সূত্রে জানা যায়, হরতাল কিংবা অবরোধে দেশে একদিনে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চায় না। দেশে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হোক এটিই ব্যবসায়ীদের দাবি।
তারা বলছেন, হরতাল কিংবা অবরোধের মতো এমন কর্মসূচিতে আমরা উদ্বিগ্ন। রাজপথে থাকা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর টানা কর্মসূচির ফলে নিত্যপণ্যে দাম বেড়ছে জ্যামিতিক হারে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠে বাজারে গেলে। শীতের মওসুমে বাজারে ভরপুর সবজি থাকলেও ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে চওড়া দামে। আলু, পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও অন্যসব পণ্যে চাওয়া হচ্ছে চওড়া দাম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী শিবির দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। মাঠে সরব না থাকলেও আতঙ্ক বিরাজ করছে সব জায়াগায়। নগরের গণপরিবহন আংশিক চললেও দূরপাল্লার গাড়ি তেমন ছেড়ে যাচ্ছে না। ফলে জেলা-উপজেলা শহর থেকে সবজিবাহী ট্রাক সময়মতো রাজধানীতে পৌঁছাতে পারছে না। বাজারে পর্যাপ্ত শীতকালীন সবজি থাকলেও চড়া দামে কিনতে হয় ক্রেতাদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলমান হরতালে ঝুঁকি নিয়ে মাল আনতে হয়। আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হয়। তাই একটু বেশি দামে বিক্রি করা লাগছে। রাজধানীতে ভোর থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরব কারওয়ান বাজার। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলাসহ অন্য শাক-সবজির সরবরাহ ভালো থাকায় সপ্তাহ ব্যবধানে দাম কিছুটা কমলেও উচ্চমূল্যেই কিনতে হয় ভোক্তাকে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, লাল শাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, পালং শাক ২০ থেকে ২৫ টাকা, মুলা শাক ১৫ থেকে ১৮ টাকা, টমেটো ৮০ থেকে ৯০ টাকা, সিম ও শালগম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ফুলকপি আকারভেদে ৪০ থেকে ৫৫ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও মূলা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি সবজি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। যাত্রাবাড়ী পাইকারি কাঁচাবাজার সমিতির এক নেতা বলেন, বাজারে বিএনপির চলমান অবরোধের কিছুটা প্রভাব আছে। কিছুটা ঝুঁকি হলেও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক হওয়ায় সরবরাহ ভালো। তাই শীতের শুরুতে সবজির বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। তিনি বলেন, আসছে শীতে সবজির দাম আরও কমবে। এদিকে অবরোধে গাবতলী বাস টার্মিনালের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে না গেলে যাত্রী আসে না। কিন্তু ঠিকই জায়গার ভাড়া ও কর্মচারীকে ধরে রাখার জন্য বেতন দিতে হয়। এ অবস্থায় অনেকের পুঁজিতে টান পড়েছে।
গাবতলীর আন্ডারপাসের পাশে একটি হোটেল চালান জয়নাল। এ জন্য তাকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। অদৃশ্য লাইনম্যানকে ২০০ টাকা চাঁদাও দিতে হয় প্রতিদিন। নিজের পাশাপাশি একজন কর্মচারী আছে তার। অবরোধের কারণে সমস্যায় পড়েছেন জয়নাল। অবরোধর দিন বিক্রি নেমেছে তিন ভাগের এক ভাগে। তিনি বলেন, অবরোধই তো সব খারাপ করে দিচ্ছে। যাত্রী নেই, বেচাকেনা অনেক কমে গেছে। আবার যাত্রী না থাকলে পরিবহন শ্রমিকদের বাকিতে খেতে দিতে হয়। তারা আমার নিয়মিত গ্রাহক; তাদের হাতে টাকা নেই। এই বিপদে সব সময় টাকা দিতে পারেন না তারা। কিন্তু আমি কুলাতে পারছি না। এভাবে আর ১৫ দিন চললে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে পালাতে হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসুক। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা জরুরি। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে অত্যন্ত স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে যা ব্যবসা, বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবে সমপ্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।’ রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সব ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড পরিহারের আমন্ত্রণ জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘সরকার দাম নির্ধারণ করলেও মুক্তবাজার ব্যবস্থায় তা কার্যকর করা সহজ হবে না। সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে দরকার নজরদারি বৃদ্ধি এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা। নইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে অভিযান চালানোর অর্থ হবে ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর মতো, যাতে মূল রোগ সারবে না।’