নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই ৫, ২০২৫, ১২:১১ এএম
রাজধানীজুড়ে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান মানি এক্সচেঞ্জগুলো এখন অপরাধীদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে। একের পর এক সংঘবদ্ধ ছিনতাই, ডাকাতি ও হামলার ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে শত শত প্রতিষ্ঠান। দুর্ধর্ষ এসব অভিযানে কেবল অর্থ নয়, ঝুঁকিতে পড়েছে জীবনও। সমপ্রতি তেজগাঁও, মিরপুর, ধানমন্ডি, গুলশানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পেশাদার অপরাধীরা নিয়মিতভাবে বড় অঙ্কের টাকার সন্ধান পেয়ে হামলা চালাচ্ছে মানি এক্সচেঞ্জের টাকার গাড়িতে।
গোয়েন্দা পুলিশের মতে, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকেই টাকার গতিবিধির তথ্য পাচার হচ্ছে। আবার হুন্ডির অর্থ পরিবহনের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই পুলিশের সহায়তা চায় না, ফলে তারা হয়ে ওঠে দুর্বৃত্তদের সহজ শিকার।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় এসেনসিয়াল ড্রাগ অফিসের সামনে এক মানি এক্সচেঞ্জের প্রাইভেটকার থামিয়ে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইকারীরা লুট করে প্রায় ৫ লাখ সৌদি রিয়াল। টাকার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। গাড়িতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী তুহিন জিম্মি হন বলে দাবি করা হলেও পরে তদন্তে উঠে আসে তিনি নিজেরাই ছিনতাইয়ের নকশাকার। জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য পেয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ যৌথ অভিযানে তুহিনসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং উদ্ধার করে ২ লাখ ৬৯ হাজার রিয়াল।
তেজগাঁওয়ের ঘটনার আগে মিরপুর ছিল ছিনতাইকারীদের রণক্ষেত্র। গত ১৫ জানুয়ারি রাতে, জিসান মানি এক্সচেঞ্জের কর্মীদের কাছ থেকে ছিনতাই হয় ৭৪ লাখ টাকা ৩ মে রাতে, প্রাণ মানি এক্সচেঞ্জের মালিক থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় ৫০ লাখ টাকা। ২৭ মে সকালে, মাহমুদ মানি এক্সচেঞ্জের মালিক জাহিদুর রহমানকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে ছিনতাই করা হয় ২২ লাখ টাকা। সবগুলো হামলায় অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে এসে টার্গেট করে টাকার গাড়ি। সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল না হলে ঘটনাগুলোর তদন্ত হয়তো এগিয়ে যেত না— মন্তব্য পুলিশের একাধিক সূত্রের।
গুলশান-১, গুলশান-২ ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায়ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড় দেয়নি ছিনতাইকারীরা। ডেন্টা ব্যুরো ডি চেঞ্জ লিমিটেড (ধানমন্ডি), সিটি মনিটারি এক্সচেঞ্জ প্রা. লিমিটেড (গুলশান-২), রাতুল মানি চেঞ্জার (গুলশান-১)। এসব প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের অর্থ লুট হলেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার নেই, উদ্ধার নেই কোনো অর্থ।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, “অপরাধীরা আগে থেকেই টাকা পরিবহনের তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের একাধিক তদন্তে দেখা গেছে, মানি এক্সচেঞ্জের ভেতরের কেউ এই তথ্য চক্রে সরবরাহ করছে।” তিনি আরও বলেন, “বারবার অনুরোধ করা হলেও টাকা পরিবহনের সময় অনেকেই পুলিশের সহায়তা নেয় না। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।”
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে ৬২৬টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ২২৫টির লাইসেন্স বৈধ। বাকি প্রায় ৪০০টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদনহীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে, যাদের অনেকে হুন্ডি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত। সংগঠনের মহাসচিব প্রকৌশলী গৌতম দে বলেন, “ঢাকার সাতটি প্রতিষ্ঠানে সমপ্রতি সশস্ত্র ডাকাতি হয়েছে। কিছু ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেও টাকা উদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকে বারবার চিঠি দিয়েও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।”
প্রাণ মানি এক্সচেঞ্জের মালিক আবদুল ওয়াহাব বলেন, “ছিনতাইয়ের পর কয়েক দিন পুলিশ এসেছিল। পরে কোনো সাড়া নেই। অভিযোগ দেয়ার পরেও মামলা হয়নি। এখন আমরা নিজেরাই নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় আছি।”
গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অধিকাংশ ঘটনায় টাকা লুটে নেয়ার পেছনে হুন্ডি চক্র জড়িত। তাই অনেক প্রতিষ্ঠানই তদন্তে সহযোগিতা করছে না। তবে পুলিশ বলছে, প্রতিটি ঘটনায় তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। শিগগিরই বেশ কয়েকটি ঘটনায় আরও গ্রেপ্তার ও অর্থ উদ্ধার সম্ভব হবে।