Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

জ্বালানি সংকট নিরসনে ক্যাবের ১৩ দফা দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

এপ্রিল ২৯, ২০২৩, ০৬:৩১ পিএম


জ্বালানি সংকট নিরসনে ক্যাবের ১৩ দফা দাবি

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানি সংকট নিরসনে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা, মূল্যাহার নির্ধারণসহ ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে।

শনিবার (২৯ এপ্রিল) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনের চামেলি হাউসের এ টি এম শামসুল হক হলে ‘জ্বালানি সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন’ শীর্ষক এক সভায় বক্তারা এসব দাবি জানান।

ভোক্তা যেন সঠিক দাম, মাপ ও মানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেবা পায়, সেজন্য মূল্যহার নির্ধারণসহ বিদ্যুৎ জ্বালানি, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, সমতা, যৌক্তিকতা ও জবাবদিহি তথা জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সভায় উপস্থাপিত সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবি করা হয়।

উপস্থাপিত সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্যাবের ১৩ দফা দাবিগুলো হলো-

১) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত উন্নয়নে প্রতিযোগিতাবিহীন যেকোনো ধরনের বিনিয়োগ আইন ধারা নিষিদ্ধ হতে হবে।

২) সরকার ব্যক্তিখাতের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হবে না ও সরকারি মালিকানাধীন কোনো কম্পানির শেয়ার ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করবে না, আইন দ্বারা তা নিশ্চিত হতে হবে।

৩) বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানিখাতভুক্ত সরকারি ও যৌথ মালিকানাধীন সব কোম্পানির পরিচালনা বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উভয় বিভাগের সব আমলাদের প্রত্যাহার করতে হবে।

৪) নিজস্ব কারিগরি জনবল দ্বারা স্বাধীনভাবে উভয় খাতের কোম্পানি বা সংস্থাসমূহের কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে। সে জন্য আপস্ট্রিম রেগুলেটর হিসেবে মন্ত্রণালয়কে শুধুমাত্র বিধি ও নীতি প্রণয়ন এবং আইন, বিধি-প্রবিধান অনুসরন ও রেগুলেটরি আদেশসমূহ বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নজরদারি ও লাইসেন্সিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। পাশাপাশি ডাউনস্ট্রিম রেগুলেটর বিইআরসিকে সক্রিয়, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

৫) মুনাফা ব্যতিত কস্ট বেসিসে ৫০ শতাংশের অধিক বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন সরকারি মালিকানায় হতে হবে। কস্ট প্লাস নয়, সরকার শুধু কস্ট বেসিসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা দেবে।

৬) গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থ যথাক্রমে গ্যাস অনুসন্ধান, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি আমদানিতে বায় ভোক্তার ইকুইটি বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হতে হবে।

৭) প্রাথমিক জ্বালানি মিশ্রে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনায় কয়লা ও তেলের অনুপাত কমাতে হবে। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও মজুত বৃদ্ধি এবং নবায়যোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বারা জ্বালানি আমদানি নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

৮) জলবায়ু তহবিলসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উৎস থেকে উক্ত ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ঋণ নয়, ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত হতে হবে। সে ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্তদের সক্ষমতা উন্নয়নে বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিশ্চিত হতে হবে। 

৯) বিদ্যুৎ, জীবাশ্ম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন নীতি, আইন, বিধি-বিধান ও পরিকল্পনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্পাদিত প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

১০) জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানির মূল্যহার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘এনার্জি প্রাইস স্ট্যাবলাইজড ফান্ড’ গঠিত হতে হবে।

১১) ভোক্তার জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণ ও জ্বালানি সুবিচারের পরিপন্থি হওয়ায় (ক) দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রদ হতে হবে, এবং (খ) বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন ২০০৩ সংশোধনক্রমে সংযোজিত ধারা ৩৪ক রহিত হতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

১২) ইতোমধ্যে (ক) বাপেক্স ও সান্তোষের মধ্যে মগনামা ২ অনুসন্ধান কূপ খননে সম্পাদিত সম্পূরক চুক্তি, (খ) বিআরইবি ও সামিট পাওয়ার লিমিটেডের মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি, এবং বিপিডিবি ও সামিট পাওয়ার লিমিটেডের মধ্যে সম্পাদিত মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্টের বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি বেআইনী ও জনস্বার্থ বিরোধী, এবং জ্বালানি সুবিচারের পরিপন্থি প্রতীয়মান হওয়ায় এ-সব চুক্তি বাতিল হতে হবে। অনুরূপ অভিযোগে অভিযুক্ত অনান্য চুক্তিসমূহও যাচাই-বাছাইক্রমে বাতিল হতে হবে।

১৩) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়নে সম্পাদিত সকল চুক্তি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পাদনের লক্ষ্যে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত মডেল চুক্তি মতে হতে হবে।

এ সময় বক্তারা বলেন, প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অন্যায় এবং অযৌক্তিক ব্যয় ও মুনাফায় সরবরাহ হওয়ায় আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি গণশুনানিতে বারবারই আপত্তির সম্মুখীন হয়। প্রতিটি গণশুনানীতে প্রমাণিত হয়, ব্যয় ও মুনাফা ন্যায্য ও যৌক্তিক হলে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি বাণিজ্য লুণ্ঠনমুক্ত হতো ও আর্থিক ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে থাকতো। ফলে সরকারকে ভতুর্কি এবং ভোক্তাকে মূল্যহার বৃদ্ধির চাপে থাকতে হতো না। 

বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহে সম্পৃক্ত অন্যায় ও অযৌক্তিক তথা লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা রোধ করা গেলে ভর্তুকি লাগে না এবং মূল্যবৃদ্ধির চাপও থাকে না বলেও জানান বক্তারা। অথচ ভর্তুকি প্রত্যাহারে মূল্যহার বেশী বেশী বৃদ্ধি অব্যাহত রইল এবং মূল্যহার নির্ধারণের কাজটি বিইআরসি আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উভয় বিভাগের আমলাদের হাতে দেয়া হলো।

ভোক্তারা অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাত এবং চরম বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের শিকার হচ্ছে জানিয়ে বক্তারা বলেন, কম-বেশী ৭ শতাংশ হারে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি হলেও উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ১২ শতাংশ। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিজনিত আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় তেল, গাল, ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমানো হচ্ছে।

অন্যদিকে কয়লা ও গ্যাস আমদানি চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় বিদ্যুৎ আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে বলে জানান বক্তারা। তারা বলেন, উৎপাদনক্ষমতা ব্যবহার কমে আসছে। কিছু দিন আগেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হতো প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এখন দিতে হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে ২০২২ সালের গণশুনানিতে জানা যায়, প্রতি ঘনমিটার দেশীয় কোম্পানির গ্যাস কেনা হয় ১ দশমিক ০৩ টাকায়। অথচ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি হয় প্রতিঘনমিটার ৮৩ টাকায়। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থে গ্যাস মজুত ও উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নেই বললেই চলে। তহবিলের ৬৫ শতাংশ অর্থই অব্যবহৃত।
এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদ্যুতের ১০ শতাংশ হতে হতো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বাস্তবে এক শতাংশও হয়নি। সৌরবিদ্যুৎ এখন ১০ টাকা ব্যবহারেই উৎপাদন সম্ভব। অথচ আমদানিকৃত কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়হার গড়ে ১৭ থেকে ১৮ টাকা। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরো বেশি। বিদ্যুৎ ওলিগোপলির শিকার না হলে বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ হতো গুরুত্বপূর্ণ।

আর ইউএসএআইডির অনুশীলন অনুযায়ী, গ্রীডে সংযোগযোগ্য সম্ভাব্য সৌর-পিডি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৫০ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণাগারের উইন্ড ম্যাপিং-এর তথ্য অনুযায়ী, বায়ু-বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট।

এদিকে ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপি জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত হবে। সে লক্ষ্যে, দেশে দেশে জ্বালানি সংরক্ষন ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং পরিবহণ, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও আবাসিকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে প্রথাগত জ্বালানিতন্ত্র দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে বলে জানান বক্তারা। তারা বলেন, দেশে দেশে জন্ম নিচ্ছে কার্বণমুক্ত নতুন জ্বালানিতন্ত্র। এ জ্বালানিতন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি খাতে সুশাসন এবং সমতাভিত্তিক জ্বালানি বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। এতে বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

আর সেই সুযোগে জ্বালানি নিরাপত্তা সংরক্ষণে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনই এখন মূল লক্ষ্য বলে জানান বক্তারা। সে লক্ষ্যে ক্যাব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংস্কার প্রস্তাব করেছে। সে-সব প্রস্তাব সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে সভায় উপস্থাপিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে গ্যাস খাত সংস্কারের এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ক্যাবের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বদরুল ইমাম। 

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ক্যাবের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, স্থপতি ইকবাল হাবিব, ক্যাবের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক এম এম আকাশ, সংসদ সদস্য শামিম হায়দার পাটোয়ারী প্রমুখ।

এইচআর

Link copied!