ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Amar Sangbad

ইনস্টাগ্রাম

Amar Sangbad

এক্স

Amar Sangbad


লিংকডইন

Amar Sangbad

পিন্টারেস্ট

Amar Sangbad

গুগল নিউজ

Amar Sangbad


হোয়াটস অ্যাপ

Amar Sangbad

টেলিগ্রাম

Amar Sangbad

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Amar Sangbad


ফিড

Amar Sangbad

ঢাকা রবিবার, ০৩ আগস্ট, ২০২৫
Amar Sangbad

সংসদের উচ্চকক্ষের হাত ধরে কী ফিরবে জবাবদিহি?

শাহেদ শফিক

শাহেদ শফিক

আগস্ট ৩, ২০২৫, ০১:১১ পিএম

সংসদের উচ্চকক্ষের হাত ধরে কী ফিরবে জবাবদিহি?

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থার মাধ্যমে। এ সিদ্ধান্ত কেবল একটি কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আইন প্রণয়নের গুণমান এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বের দর্শনে এক বড় রূপান্তরের ইঙ্গিত। পাশাপাশি সময়োপযোগী এবং গভীর চিন্তার প্রতিফলনও বটে। আর এর সদস্য নির্বাচন যদি হয় প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে, তখন এটি নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রতিনিধিত্ববহুল ও বহুমাত্রিক মতামতের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠার সম্ভাবনা রাখবে। 

উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা মানেই কেবল একটি অতিরিক্ত আইনসভা নয়, বরং এটি একটি বিকল্প চিন্তা ও পুনর্মূল্যায়নের অবকাশ সৃষ্টি করবে। এই প্রেক্ষাপটে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে উচ্চকক্ষ থেকে আমাদের প্রত্যাশা কেমন হওয়া উচিত, সেই প্রশ্ন এখন সময়ের কেন্দ্রবিন্দুতে।

প্রথমত, আমরা চাই একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী কণ্ঠস্বর। নিম্নকক্ষে রাজনৈতিক শক্তি প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে একমুখী হয়ে পড়ে। উচ্চকক্ষে আমরা প্রত্যাশা করি এমন সদস্যরা থাকবেন যারা দলীয় আনুগত্যের বাইরে গিয়ে নীতি, যুক্তি এবং জনস্বার্থের ভিত্তিতে মত প্রকাশ করতে পারবেন। 

বিশেষ করে যখন কোনও বিল নিম্নকক্ষ থেকে পাশ হয় দ্রুতগতিতে বা রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের ভিতর দিয়ে, তখন উচ্চকক্ষের কাজ হবে সেই প্রস্তাবগুলো পুনর্বিবেচনা করা, তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংবিধানিক প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা।

দ্বিতীয়ত, এই কক্ষ হতে পারে সেই প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দেশের উপেক্ষিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে। পিআর পদ্ধতি সম্ভাবনা সৃষ্টি করে এমন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন বা আদিবাসী, নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি সংসদে প্রবেশ করতে পারবে, যারা সাধারণত প্রথম-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান না। ফলে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্র্য তৈরি হবে—চিন্তায়, অভিজ্ঞতায় এবং আগ্রহে। 

আমরা আশা করব এই কক্ষ হবে সেই জায়গা, যেখানে সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার এক আন্তরিক চর্চা দেখা যাবে।

তৃতীয়ত, উচ্চকক্ষকে আমরা দেখতে চাই জবাবদিহির নতুন কাঠামো হিসেবে। বর্তমান এককক্ষীয় সংসদে ক্ষমতার মনোপলি প্রায়শই সরকারি দলকে প্রশ্নহীন আধিপত্য দিতে সহায়তা করে। উচ্চকক্ষ থাকলে নির্বাহী বিভাগ আরও সংযত হবে, কারণ আরেকটি কক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন উঠবে, সংশোধনী আসবে, পর্যবেক্ষণ চালানো হবে। এক্ষেত্রে আমরা চাই উচ্চকক্ষ হবে নৈতিক বিবেকের মতো—যেখানে আলোচনার কেন্দ্র হবে যুক্তি, তথ্য ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

চতুর্থত, আমরা চাই উচ্চকক্ষ হবে নীতি নির্ধারণে গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন কেন্দ্র। নিম্নকক্ষে যেহেতু সরাসরি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা রয়েছেন, তাদের কাজ মূলত মাটির মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করা। অথচ উচ্চকক্ষের সদস্যরা যখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন, তারা হবেন দলীয় বা নাগরিক সমাজের চিন্তাশীল অংশ। এখানে নীতিনির্ধারণ, কৌশল, পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিচার করার সক্ষমতা বেশি থাকবে বলেই প্রত্যাশা করা যায়। আমরা চাই, এই কক্ষ থেকেই আসুক জাতীয় শিক্ষানীতি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার বা প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের মতো বিষয়ভিত্তিক গভীর চিন্তার সূচনা।

তবে এই প্রত্যাশাগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এই উচ্চকক্ষ কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তার উপর। এটি যদি দলীয় আনুগত্যের পুনরাবৃত্তি হয়ে দাঁড়ায়, অথবা নিছক পুঁথিগত আলোচনা আর বিতর্কের মঞ্চ হয়—তবে তা সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে না। আমাদের প্রত্যাশা হল, এই কক্ষ হবে মতবিনিময়ের কেন্দ্র, যেখানে ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু থাকবে জাতিগত মঙ্গল সাধনের অভিন্ন দায়বদ্ধতা।

অতএব, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা উচ্চকক্ষ থেকে কেবল উচ্চতার আশা করছি না, বরং গভীরতা এবং স্থিতবুদ্ধিরও প্রত্যাশা করছি। আমরা চাই এটি হবে যুক্তি, প্রতিনিধিত্ব এবং জনস্বার্থের এক নতুন প্রতীক, যেখানে দেশের প্রতিটি কণ্ঠস্বর, প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি উদ্বেগ গুরুত্ব পাবে। উচ্চকক্ষ হবে আমাদের গণতন্ত্রের ব্যাকআপ মস্তিষ্ক—যা প্রতিদিন না হলেও, প্রয়োজনের সময় রাষ্ট্রকে পথ দেখাবে, এবং তা আলো দিয়ে, দম্ভ দিয়ে নয়।

এখানে আরেকটা বিষয় জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ চালুর প্রেক্ষাপট মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে এককক্ষীয় সংসদ গৃহীত হলেও সে সময় কিছু বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা তখন বাস্তবায়িত হয়নি। আজ, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত, সামাজিক বৈচিত্র্য ও উন্নয়নের গতি বিবেচনায় দ্বিকক্ষীয় সংসদ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। কেননা একক কাঠামোতে অনেক সময় জনমতের বিচিত্রতা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা পর্যাপ্তভাবে প্রতিফলিত হয় না।

বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই উচ্চকক্ষ একটি ভারসাম্য ও গঠনমূলক পর্যালোচনার কক্ষ হিসেবে কাজ করে। যেমন—যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস, যা আইন পাসে বিলম্ব ঘটিয়ে নয়, বরং পুনরায় চিন্তার সুযোগ এনে দেয়। আবার ভারতের রাজ্যসভা, যেখানে রাজ্যগুলোর কণ্ঠস্বর সংসদীয় সিদ্ধান্তে অন্তর্ভুক্ত হয়, তা কেন্দ্রীয় শাসনে এক ভারসাম্য রক্ষা করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট একটি শক্তিশালী উচ্চকক্ষ হিসেবে শুধু আইনই নয়, বিদেশনীতি, নিয়োগ এবং অভিশংসনের মতো বিষয়ের উপরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ এ ধরনের আন্তর্জাতিক মডেলের আলোকে একটি কার্যকর, বিশ্লেষণভিত্তিক এবং দায়িত্বশীল কক্ষ হতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—উচ্চকক্ষ কেবল সংসদীয় বিতর্কের বিকল্প নয়, এটি হতে পারে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার ইনকিউবেটর। 

অনেক সময় নিম্নকক্ষে নির্বাচন-ভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দলীয় চাপের কারণে যেসব প্রতিনিধি গভীর চিন্তা বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারেন না, উচ্চকক্ষে তাদের জন্য এমন একটি পরিসর তৈরি হবে—যেখানে পরিণত চিন্তার জায়গা থাকবে। এখান থেকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক, নীতি প্রণেতা এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ তৈরি হতে পারে, যেটি আমাদের রাজনীতির পরবর্তী প্রজন্মকে আরও পরিণত ও দায়িত্বশীল করে তুলবে।

সবশেষে, এই উচ্চকক্ষকে কেন্দ্র করে আমরা চাই গণতন্ত্রে নতুন আস্থা ফিরে আসুক। অনেক সময় রাজনীতিকে দলবাজি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর বিভাজনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু উচ্চকক্ষ যদি সত্যিকার অর্থে দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে বৈচিত্র্য, যুক্তি এবং ন্যায়নীতির প্রতিনিধিত্ব করে—তবে এটি হতে পারে গণতন্ত্রে পুনরায় মানুষের আস্থা স্থাপনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। উচ্চকক্ষের মর্যাদা রক্ষা করা মানে শুধু আরেকটি কক্ষ চালু করা নয়, বরং গণতন্ত্রের মানোন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

আমরা চাই, এই উচ্চকক্ষ হোক যুক্তিনির্ভর পর্যালোচনার জায়গা, যেখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে আলোচনায় আসবে নীতির গঠনমূলক গভীরতা। এটি হবে এমন একটি কণ্ঠমঞ্চ, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী, সংখ্যালঘু, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব বাস্তবায়ন পাবে। 

আমরা চাই এটি নির্বাহী ক্ষমতার উপর একটি দায়িত্বশীল নজরদারির কাঠামো তৈরি করুক, নীতি নির্ধারণে যুক্তিসম্মত প্রশ্ন তুলুক এবং ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তায় দূরদর্শী অবদান রাখুক। সংক্ষেপে, এই উচ্চকক্ষ হোক জবাবদিহিমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও চিন্তাশীল গণতন্ত্রের একটি দৃঢ় স্তম্ভ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

***মতামত লেখকের নিজস্ব

ইএইচ

Link copied!