Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১০ মে, ২০২৫,

আমরা গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছি

মো. মাসুম বিল্লাহ

ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ১২:৫৯ এএম


আমরা গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছি

অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি)। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান ও জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টির সভাপতি। বিজয়ের পাঁচ দশক পর দেশ কতটা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে এবং সাম্প্রতিক সংকট-সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে দৈনিক আমার সংবাদের সাথে কথা বলেছেন খ্যাতিমান এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমার সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার মাসুদুল হাসান অলড্রিন

আমার সংবাদ : বিজয়ের পাঁচ দশক পেরিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক কতটুকু বলে আপনি মনে করেন...

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : বিজয়ের পাঁচ দশক পেরিয়ে আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে যে অবস্থা ছিল, তার থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। তবে বিজয় দিবস এলে আমরা সব সময় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হই— ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল, তার সঙ্গে প্রাপ্তির কতটুকু সংযুক্তি ঘটেছে । একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল আত্মসম্মান নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা, নিজের পরিচয় দেয়া। যেহেতু আমরা এতটুকু পেয়েছি, এ কারণে প্রত্যাশার দিক থেকে আমরা পরিপূর্ণ অবস্থানে আছি। প্রাপ্তির দিক থেকেও আমরা পরিপূর্ণ বলতে পারি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির  মধ্যে আমি কোনো ফারাক দেখি না। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাদের প্রত্যাশাই ছিল মুক্তি, আমরা তা অর্জন করেছি। পরবর্তীতে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি ও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করি।  ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা দেশে ফিরে এসে বহু সময় আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বলেছেন, স্বাধীনতার অর্থ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও যুক্ত আছে। জনগণের দ্বারপ্রান্তে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দিতে হবে। সার্বিক এ বিষয়গুলো আমরা সব সময় স্মরণে রাখি। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, যার  পেছনে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন; এরপর নতুন করে প্রত্যাশার কিছু নেই। এখন আমরা স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জীবনযাপন  করছি।

আমার সংবাদ : বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছে বলে কী মনে করেন...

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, তার মূল লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় যে বিষয়টি ছিল— সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার; এ তিনটিই গণতন্ত্রের মূল কথা। আমরা গণতন্ত্রের পথে হেঁটে চলেছি। যদিও এখনো পরিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একটি  ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হারানোর পরে দীর্ঘদিন এ দেশ সামরিক শাসনের কব্জায় ছিল। তখন সামরিকতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের অপশাসনে বাংলাদেশের ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘুরছিল। সেখান থেকে আমরা আবার গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছি। তবে এখনো এটা বলার সময় আসেনি যে, আমরা সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। তবে এর চর্চা অব্যাহত আছে। গণতান্ত্রিক চর্চা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। জাতি ধীরে ধীরে এর সুফল পাবে। এটিও ঠিক, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো যারা শত শত বছর ধরে গণতন্ত্র চর্চা করছে, যেমন— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশও বলবে না যে, তারা শতভাগ গণতন্ত্রে পৌঁছে গেছে বা সফল হয়েছে।

আমার সংবাদ : বিএনপির সব সংসদ সদস্য সম্প্রতি একযোগে পদত্যাগ করেছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন...

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : যদিও এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাদের আছে। তবে জাতীয় সংসদ রাজনৈতিক দলের কথা বলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করা উচিত। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, পদত্যাগ কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। বরং তারা যে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তারা এ কথাগুলোই বলতে পারতেন। এতে দেশ-বিদেশে কথাগুলো বেশি গুরুত্ব পেত। বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে দাঁড়িয়ে যে কথাগুলো বলেন, দেশবাসীর কাছে তা গুরুত্ব পায়, দেশের মানুষ বুঝতে পারে কোন কোন বিষয়ে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে। যদিও এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত; কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া পদত্যাগ করার কোনো মানে নেই।

আমার সংবাদ : মুক্ত গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে মনে করেন।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকায় ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়  প্রতিটি ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।  গণতন্ত্র রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হবে না; তবে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা সরকারের দায়িত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। বিরোধী রাজনৈতিক দলও তাদের মতামত জোরালোভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে পারছে। সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বিরোধী দল তার প্রতিক্রিয়া কী দেখাচ্ছে, সরকার আবার পাল্টা কী বলছে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী বলছে— এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষ তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে। সব বিষয়ই জনগণের সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে। এতে স্বাধীন গণমাধ্যম বিকাশের ও মতপ্রকাশের সংস্কৃতি নিশ্চিত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে আর কোনো ঘটনা লুকানো যায় না।

আমার সংবাদ : বিজয়ের এত বছর পরও দেশের ‘অর্থনীতি গোষ্ঠীগত পুঁজিবাদের খপ্পরে’। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে এর সম্পর্ক এবং দ্রব্যের এই উচ্চমূল্যের কারণ কতটা স্থানীয় বা কতটা বৈশ্বিক বলে মনে করেন...

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : সম্প্রতি এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর একটা বড় অংশ গোষ্ঠীগত স্বার্থ প্রাধান্য দিচ্ছে, তাদের দূরভিসন্ধির কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা  সিন্ডিকেট করে হঠৎ সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ খুব কষ্টে আছে। এমনকি নিম্ন-মধ্যত্তি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশ চাপে আছে। কাগজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে প্রকাশনাশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার  পেছনে স্থানীয় সংকটের পাশাপাশি বৈশ্বিক সংকটকে নিজের স্বার্থে অপব্যবহার করার অশুভ চক্রের অপতৎপরতাও আছে। এসব বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আমাদের নৈতিকতাসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৈতিকতার চর্চা শুরু করতে হবে। কারণ, ওইসব  ব্যবসায়ীও  কোনো এক সময় ছাত্র ছিলেন, যারা সঠিক নৈতিক শিক্ষা পাননি হয়তো। বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে বিকেন্দ্রিকরণ করতে চেয়েছিলেন, কৃষক সমবায় সমিতি করতে চেয়েছিলেন। মাঠে উৎপাদিত ফসল সমবায়ের মাধ্যমে বিক্রি হবে— এমন একটি পরিকল্পনাও করা হয়েছিল তখন। এর বাস্তবায়ন হলে মধ্যস্বত্বভোগী থাকত না এবং ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্যও হতো না। আমাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতিতে ফিরে যাওয়া উচিত। রাতারাতি আমরা এটা বাস্তবায়ন করতে পারব না; তবে প্রক্রিয়াটি শুরু করা উচিত। কৃষক সমাজ যাতে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে শুধুমাত্র কৃষকদের ক্ষেত্রে সমবায় চাষ পদ্ধতি শুরু করা যায়। জনগণ বৈশ্বিক সংকটের কারণে মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিলেও অতিমুনাফালোভীদের সিন্ডিকেট মেনে নেয়া যায় না।

আমার সংবাদ : কয়েক দশকে শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি বলে নানা মহলে কানাঘুষা হচ্ছে। গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন হয়নি এবং সে সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণার ক্ষেত্রও ততটা প্রসারিতও হয়নি। এসব বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন জানাবেন...

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : গত পাঁচ দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় বহু শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে। এই বছর এসএসসি পরীক্ষায়  দুই লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী  জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ সবকিছুই উন্নতির সূচক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গুণগত শিক্ষা অর্জনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সেক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজন আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। প্রাথমিক স্তরে একমুখী একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের কিছু সুপারিশ যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারতাম, হয়তো শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। তবে আশার কথা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০১০ সালে আমাদের একটি শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছেন। এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে, একটি দেশ ১৯৭৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কোনো শিক্ষানীতি ছাড়া চলেছে। সরকার ১৯৯৬ সালে একটি উদ্যোগ নিলেও স্বল্পসময়ে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এরপর সরকার পরিবর্তনের পর বিষয়টি আর এগোয়নি। আমরা আবার ২০২৩ সালে একটি নতুন শিক্ষানীতি পেতে যাচ্ছি। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রণীত বৈষম্যহীন একমুখী শিক্ষানীতিতে ফিরে যাবার বিকল্প নেই।

Link copied!