Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪,

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা

জীবনযাত্রায় বাড়তি চাপ

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪, ১২:২১ এএম


জীবনযাত্রায় বাড়তি চাপ

মার্চ থেকে কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানালেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তেলের দাম সমন্বয় করা হবে বলেও আগাম বার্তা দিলেন প্রতিমন্ত্রী। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্যও বাড়িয়েছে। অর্থাৎ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির পর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে সরকার তেলের মূল্য বাড়ানোর আভাস দিয়ে রেখেছে। যার নেতিবাচক সব প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। 

বিদ্যুৎ, তেল ও গ্যাসের সঙ্গে কল-কারখানার উৎপাদন থেকে শুরু করে কৃষিজমির উৎপাদন সম্পৃক্ত। উৎপাদিত পণ্য সরবরাহে ব্যবহৃত পরিবহনের জ্বালানিও এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ বিদ্যুৎ ও তেলের মূল্য বৃদ্ধি হলে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সব পণ্যের উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যার মাশুল দিতে হবে সাধারণ নাগরিকদের। নির্ধারিত হারে বেতন-ভাতা দিয়ে যারা সংসার চালান, তারা বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের বাড়তি বিল দিয়েই বাঁচতে পারছেন না। এবার অন্য সব পণ্যও কিনতে হবে আরও বেশি মূল্যে। অথচ পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি চাচ্ছেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভোগান্তি থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পাক। সে কারণে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় অনানুষ্ঠানিক প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায়ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন দেখছেন না জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তারা। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য বাড়িয়েছে সরকার। এখন আবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা এলো। যে কোনো সময় সরকার সমন্বয়ের নামে তেলের মূল্য বাড়াবে বলে শঙ্কায় রয়েছেন ভোক্তারা। 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শাকিল হোসাইন বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জানান, আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। এরপরও অজ্ঞাত কারণে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের নামে ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে সরকার। এতে এ খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়। এই অপচয় বন্ধ করে নিজস্ব উৎপাদন চালু রাখলে গ্রাহক আরও কম মূল্যে বিদ্যুৎ পাবেন। 

সাদেক মোস্তাফা নামে আরেক গ্রাহক বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, তার চলতি মাসে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ বিল এসেছে ১৯০০ টাকা। গরমের কারণে সামনের দিনগুলোতে খরচ বাড়বে; এর সঙ্গে এখন মূল্য বৃদ্ধি করা হলে সামগ্রিক বিদ্যুৎ বিল আরও বাড়বে।  

এমনিতেই ফেব্রুয়ারি থেকেই বাড়তে শুরু করে বিদ্যুৎ চাহিদা। আর গরমে সেই চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাতে পারে বলে আন্দাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দরকার হবে বিপুল পরিমাণ তেল, গ্যাস ও কয়লা। চলমান ডলার সংকট, গ্যাস সংকট এবং আর্থিক চাপের মধ্যে এবার প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে কি না— সেটি নিয়ে তৈরি হওয়া শঙ্কার মধ্যে মূল্য বৃদ্ধির খবরে ভোক্তাদের টেনশন আরও বেড়ে গেছে। 

অন্যদিকে বোরো ধান চাষের জন্য সেচ, আসছে রমজান মাস এবং গ্রীষ্মের গরমে এবার বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বর্তমান বাস্তবতায় এ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এ পরিস্থিতির মধ্যেই বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সচিবালয়ে এ ঘোষণা দিয়ে জানান, মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বিদ্যুতের দামের বিষয়টি কার্যকর করা হবে। মূলত ভর্তুকি থেকে ধীরে ধীরে বের হওয়ার জন্যই বিদ্যুতের দাম ‘সমন্বয়’ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তবে শুধু বিদ্যুৎই নাম, গ্যাসের দামও সমন্বয় করার কথা জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তবে সেটি আবাসিক বা শিল্প খাতে এখনই বাড়বে না। যে গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেটির দাম কিছুটা বাড়বে। 

প্রতিমন্ত্রী জানান, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও গ্যাসের দাম কমে যাবে। এটিও মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে কার্যকর হবে। এর আগে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, জ্বালানি তেলের দামও মার্চের প্রথম সপ্তাহে সমন্বয় হবে। এখন থেকে ‘ডায়নামিক প্রাইস’ নীতি অনুসরণ করা হবে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে অথবা কমলে সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ কিছুদিন পরপর তেলের দাম সমন্বয় করা হবে।

প্রতিমন্ত্রীর দেয়া তথ্য বলছে, প্রতিবছর শুধু বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে দিতে হয় ছয় হাজার কোটি টাকা। আগামী কয়েক বছর ধরে আমরা এ দামটা সমন্বয় করব; বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ দিতে হচ্ছে, সেখানে সমন্বয় করতে হবে। আগামী বছর আমাদের নিউক্লিয়ার চলে আসবে। ভারত থেকে কম দামে বিদ্যুৎ আসছে। দুবছরের মাঝে দুই হাজার মেগাওয়াট সোলার এর সঙ্গে যোগ হবে। তারপরও যে ভর্তুকিটা রয়ে যাবে, তা ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে। সে কারণেই এই দামটা আমাদের সমন্বয় করা দরকার।

ডলারের দাম প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য, আমরা যখন কয়লার পাওয়ার প্লান্টগুলো নিয়ে আসছি, সে সময়ে ডলারের যে ভ্যালু এবং কয়লার যে দাম ছিল, তা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রতি ডলারে প্রায় ৪০ টাকা পার্থক্য হয়ে গেছে। যখন কয়লার পাওয়ার প্লান্ট ছিল, তখন ৭০-৮০ টাকা ধরে ডলারের ভ্যালু করছিলাম। এখন আমাদের সরকারিটার ভ্যালু ধরতে হয় ১১০ টাকা। বেসরকারিটা আরও বেশি দাম। সুতরাং এই যে দামের তারতম্য, এটিকে আমাদের সমন্বয় করতে হবে। বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম বেড়ে যাওয়াকে ‘দাম বৃদ্ধি’ না বলে বারবার ‘দাম সমন্বয়’ বলছিলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই জ্বালানির দামের ওপর বিদ্যুতের দাম ওঠানামা করে। সুতরাং এর সঙ্গে আমাদের সমন্বয় করতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। 

শিক্ষক, লেখক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আনু মুহাম্মদ মনে করেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন আমরা বাস্তবে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে ‘প্রধানমন্ত্রী যখন কথা বলেন, তখন সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে’— এরকম কোনো তাগিদ থাকে না। এর বাস্তবায়ন আমরা দেখি না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যেসব কারণে হচ্ছে, সেগুলো তো অব্যাহত রয়েছে এবং সামনে আরও বাড়বে। রমজান উপলক্ষেও বাড়বে। বিদ্যুতের মূল্য আরও বাড়বে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে। 

‘সমন্বয়’ শব্দটা প্রতারণামূল বলে আখ্যা দিয়ে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তারা (সরকার) ‘সমন্বয়’ কথাটি বললেও কখনোই দাম কমায়নি। তেলের দাম ‘সমন্বয়’ করলে এখন কমানোর কথা কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম। সমন্বয় করলে তেলের দাম কমার কথা, তারা বাড়ানোর কথাটা না বলে ‘সমন্বয়’ বলে প্রতারণা করার জন্য। এটা (মূল্য বৃদ্ধি) দরকার হতো না যদি কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে ক্যাপাসিটি চার্জ না দিত। যদি এলএনজির ওপর নির্ভর না করে দেশের গ্যাস অনুসন্ধানে-উত্তোলনে জোর দিতম তাহলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানো সম্ভব ছিল। সরকার যদি  জনগণের দিকটা দেখত, তাহলে ক্রমান্বয়ে কমত। সরকার যে পথ গ্রহণ করছে, তাতে সামিট ইউনাইটেড, এস আলম, আদানি-আম্বানি সবাই লাভবান হচ্ছে। আর বাংলাদেশের জনগণের ওপর বোঝাটা তৈরি হচ্ছে। সামনে এই বোঝাটা আরও বাড়বে। এখানেই দাম বাড়ানো শেষ নয়। ক’মাস পর আবার বাড়বে বলেও আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
 

Link copied!