Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪,

প্রতিটি দুর্ঘটনায়ই মিলছে ত্যাগ ও নিষ্ঠার নিদর্শন

ঝুঁকি জেনেও অদম্য ফায়ার ফাইটাররা

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ৩১, ২০২৪, ১২:১৬ এএম


ঝুঁকি জেনেও অদম্য ফায়ার ফাইটাররা
  • বেড়েছে সুরক্ষাসামগ্রীর মান, ঝুঁকিভাতা চিকিৎসা নিশ্চিতে নিজস্ব হাসপাতাল
  • দূর করা হয়েছে রেশন বৈষম্য, বছরে দেয়া হচ্ছে ৫০টি পদক

জীবন বিসর্জনের সংগ্রামে প্রতিটি কর্মীকেই উজ্জীবিত রাখার নায়ক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন  

আগুন দেখেই সবাই যখন ছোটে নিরাপদ স্থানের খোঁজে, তখন জীবন-মৃত্যু তুচ্ছ করেই জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় সেই আগুনেই ঝাঁপ দেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। শত প্রতিকূলতায়ও গতি, সেবা আর ত্যাগের মন্ত্রগুণে অদম্য ফায়ার ফাইটাররা হাজারো চ্যালেঞ্জের বিপরীতে আগুনের সঙ্গে লড়ে রক্ষা করছেন লাখো-কোটি মানুষের যানমাল। জীবনের নিরাপত্তায় নেই কোনো গ্যারান্টি— তা জেনেও দুর্ঘটনা-কবলিত প্রতিটি প্রাণ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিটি কর্মী। 

সর্বশেষ বেইলি রোড, সীতাকুণ্ডসহ আলোচিত সবকটি প্রাণঘাতী অগ্নিদুর্ঘটনায়ও মিলেছে তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার নিদর্শন। দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে অগ্নিদুর্ঘটনা। তাও আবার বহুতল ভবন, কখনো মার্কেট, কখনো শপিংমল-শিল্প প্রতিষ্ঠান কিংবা বাসাবাড়িতেও। সেই সংবাদ প্রাপ্তির ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই প্রথম সাড়া দেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। প্রতিটি দুর্ঘটনাতেই একই চিত্র, একই দৃশ্য। সামর্থ্যের বাইরে কিংবা প্রাণঘাতী জেনেও আগুন নেভানোর চেষ্টায় মত্ত একমাত্র ফায়ার ফাইটাররাই উপেক্ষা করছেন শিথিলতার বিন্দুমাত্রাও। অথচ এসব অগ্নিসেনারাই যখন আহত কিংবা নিহত হন, তখন কেবল শান্ত্বনার বাণীতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শতপ্রাণ রক্ষার এই সংগ্রাম। আর আহত হয়ে যারা হাসপাতালে যান, হাসপাতালের বেডে থাকা অবস্থায়ও তাদের চোখে মুখে দেখা যায় নব উদ্যমে কাজ করার প্রত্যয়।

সেবার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত ফায়ার ফাইটারদের মধ্যে বিদ্যমান উদ্যমও কখনো কখনো ম্লান হওয়ার উপক্রম ঘটে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে। নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানির উৎসের অভাব, স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার স্বল্পতা, অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট ও ট্রাফিক জ্যাম, জনসচেতনতার অভাব। সবকটি বিষয়ই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবুও কোনো চ্যালেঞ্জই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি অধম্য ফায়ার ফাইটারদের। 

অধিদপ্তরের সর্বশেষ একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সিতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপো বিস্ফোরণ, গুলশান-২ এর আবাসাকি ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা সফলতার সাথে মোকাবিলার মাধ্যমে বিগত তিন বছরে ৬৬ হাজার ৭৮০টি অগ্নিদুর্ঘটনা ও ৩১ হাজার ৩৬৫টি অন্য দুর্ঘটনা মোকাবিলা করে চার হাজার ৩৮১ কোটি টাকা সম্পদ রক্ষাসহ ২৮ হাজার ৪৮৮ জনকে জীবিত এবং পাঁচ হাজার ৫৫৮ জনকে মৃত উদ্ধার করেন ফায়ার ফাইটাররা। অগ্নিনির্বাপনকালে বিএম কনটেইনার ডিপোর ১৩ জন অগ্নিবীরসহ ফায়ারফাইটার মিলন মিয়া এবং ডুবুরি আব্দুল মতিন শাহাদাতবরণ করেন। অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে বিগত তিন বছরে ৪৩ হাজার ৩০৫ জন রোগী পরিবহন করে ফায়ার সার্ভিস। যা অন্যান্য সংস্থার চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এরপরও আরও বেশি দুর্ঘটনার সংবাদ প্রাপ্তির লক্ষ্যে নিজস্ব ফায়ার হটলাইন ১৬১৬৩ চালু করায় দ্রুত সময়ের মধ্যে জানা যাচ্ছে দুর্ঘটনার সংবাদ।

সুশৃঙ্খল বিশাল কর্মীবাহিনীর এই সংস্থার সার্বিক অগ্রগতি ও আধুনিকায়নের নেতৃত্বে রয়েছেন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর সংস্থার প্রতিটি সদস্যের কাছেই ফায়ার সার্ভিসের অগ্রগতি ও আধুনিকায়নের প্ল্যানিং মাস্টার হিসেবে শিরোনাম হয়েছিলেন গণমাধ্যমের। তারই ধারাবাহিকতায় কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি ও সেবার মান আরও গতিশীল করতে ১২৬ জনকে পদক ও ২৭৬ জনকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বিগত তিন বছরে। শুধু তাই নয়, ছয় মাস মেয়াদি বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে এক হাজার ৬৪৫ জনকে ফায়ার সেফটি-বিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাঁচ হাজার ৯৩৮ জন নতুন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার ও ২৩০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রশিক্ষণ, ৪৫ হাজার ৪৮৪টি অগ্নিনির্বাপণ মহড়া, আট হাজার ৩৭৪টি সার্ভেসহ পাঁচ লাখ আট হাজার ৪০৭ জন জনসাধারণকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তসহ স্টিল স্ট্রাকচার-অয়েল ফায়ার-গ্যাস ফায়ার ফাইটিং প্রশিক্ষণের সিমুলেটর স্থাপন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে সর্বোচ্চ টিটিএল গাড়ি ফায়ার সার্ভিসের বহরে যুক্তকরণসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। ‘বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব ফায়ার একাডেমি’ স্থাপনের লক্ষ্যেও ইতোমধ্যে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ১০২.৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সমাজসেবা প্রদানে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ গত বছর স্বাধীনতা পুরস্কারও অর্জন করে ফায়ার সার্ভিস।

ফায়ার সাভির্সের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা ও বেশ কজন ফায়ার ফাইটার আমার সংবাদকে বলেন, বর্তমান মহাপরিচালক যোগদানের পর দরবার হলের একটি দরবারে তিনি সামগ্রিকভাবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন তা জানতে চান। যা প্রতিটি কর্মীকেই উজ্জীবিত করবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুটি বিষয়ে প্রত্যাশার কথা জানান। এর একটি ফায়ার ফাইটারদের কাজের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে পদক প্রদান, অপরটি আজীবন রেশন। দায়িত্ব গ্রহণের দেড় বছরের মধ্যেই তিনি তাদের দুটি প্রত্যাশাই পূরণ করেন। 

এ ছাড়াও সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জন ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনার পর সামগ্রিকভাবে ফায়ার ফাইটারদের জন্য সরকারের সঙ্গে কথা বলে ‘অগ্নিবীর’ খেতাবও প্রতিষ্ঠান করেন তিনি। এতে উজ্জীবিত ফায়ার ফাইটাররা। জনসাধারণের প্রতি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রত্যাশা, অগ্নিদুর্ঘটনায় ফায়ার ফাইটাররা যাওয়ার আগে সাধারণ মানুষ যেন সচেতন হয়, প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করেন। এ বিষয়ে যেন শিখে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও বর্তমান মহাপরিচালক কর্তৃক অনলাইনে ব্যাপকহারে প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার গৃহীত পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে। 

অর্থাৎ কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ শুধু ফায়ার সার্ভিসকেই ডাকবে এ ধারণায় না থেকে ফায়ার সার্ভিস দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই দুর্ঘটনা রোধে, দুর্ঘটনা যেন না ঘটে অথবা দুর্ঘটনা যেন কম ঘটে— এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আগে থেকেই সচেতন করার জন্য গৃহীত সব পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। তারই অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে তিন হাজার পরিদর্শন কিংবা সার্ভে পরিচালনা, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে পাঁচ হাজার ৮৮২টি মহড়া ও ছয় হাজার ৭০০টি টপোগ্রাফি ও গণসংযোগ পরিচালনা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১০০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৩৭ হাজার কর্মরতদের ও এক হাজার ১৫০টি সরকারি—বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা আবাসিক ভবনে মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান ও ৮১০ জন নতুন কমিউনিটি ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ  দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সংস্থাটি।

জনসাধারণকে অগ্নিনিরাপত্তা দিতে যাদের এত ত্যাগ, সংগ্রাম তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ব্যক্তিগত সুরক্ষা-সামগ্রীর মান বেড়েছে বহুগুণ। হ্যান্ডস গ্লাভস থেকে শুরু করে গামবুট সব কিছুতেই পরিবর্তন আনা হয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে ঝুঁকিভাতা। দুর্ঘটনায় যেসব ফায়ার ফাইটাররা পঙ্গুত্ববরণ করছেন তাদের ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে চার লাখ টাকা পঙ্গুত্ব ভাতা দেয়া হচ্ছে। আর কারো প্রাণহানি ঘটলে পরিবারকে দেয়া হচ্ছে আট লাখ টাকা। ফায়ার ফাইটারদের চিকিৎসায় মিরপুরে নিজস্ব হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে জনবল রিক্রুটের পর্যায়ে রয়েছে। 

তিনি বলেন, ফায়ার ফাইটারদের মনোবল চাঙ্গা করতে দূর করা হয়েছে রেশন বৈষম্য। অবসের যাওয়ার পরও স্বামী-স্ত্রী দুজন পাবেন আজীবন রেশন। এ ছাড়াও অতীতে বছরভিত্তিক একটি বা দুটি করে পদক দেয়া হতো। বর্তমান সরকার প্রতি বছরই ৫০টি করে পদক দিচ্ছে। সামগ্রিক কার্যক্রমে ফায়ার ফাইটাররা আরও বেশি উজ্জীবিত এবং হয়ে উঠছে অদম্য।
 

Link copied!