মামুনুর রশিদ, চট্টগ্রাম ব্যুরো
আগস্ট ১৩, ২০২৫, ১২:০০ এএম
গত বছরের এমন সময়ে দেশের এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সহজে আদৌ কেউ নিবেন কিনা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারছিল না বন্দর সংশ্লিষ্টদের। দেশের একমাত্র প্রধান অর্থনীতির মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙে পড়ার শঙ্কায় ওই মুহূর্তে দায়িত্ব নিলেন রিয়াল অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান।
তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়, কে এই মহান সাহসী ব্যক্তি। ছিল না কোনো নিরাপত্তা, শুধু ভয় আর শঙ্কা। চট্টগ্রাম বন্দরকে খাদের কিনারা থেকে অর্থনীতিকে মাইলফলকে তুলেছেন মনিরুজ্জামান।
গত বছরের ১১ আগস্ট তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। দৈনিক আমার সংবাদের সাথে কথা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের রাজপুত্র এস এম মনিরুজ্জামানের। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এতো বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের গল্পের রহস্য যদি বলেন। জবাবে তিনি বলেন, সাহস-সততা, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধেই সব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। মহান আল্লাহ সাথে ছিলেন এবং বন্দরের সব কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় আজ বন্দরকে অর্থনীতির মাইলফলকে পৌঁছাতে সম্ভব হয়েছি।
অতীতের চেয়ারম্যানরা ছদ্মবেশে থার্ডপারসন দিয়ে ব্যবসা করতেন বলে আমরা শুনতাম। আপনার সময়ে এমন কোনো কিছু শুনতে পেলাম না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ব্যবসার কথা বাদ দিলাম। আমার কোনো আত্মীয় পরিচয়ে বন্দর পরিদর্শন করতে এসেছে এমন নজিরও দেখাতে পারবেন না।
আপনার সফলতা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা প্রসঙ্গে যদি বিস্তারিত বলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ৪৮ বছরের পথচলায় এই প্রথম বছরে ৩২,৯৬,০৬৭ টিইইউ (২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট) হ্যান্ডলিং করে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৪% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৩১,৬৮,৬৯০ টিইইউ, অর্থাৎ অতিরিক্ত ১,২৭,৩৭৭ টিইইউ হ্যান্ডলিং হয়েছে এ বছর।
২০২৪ সালেও বন্দরের কার্যক্রম ছিল চমকপ্রদ। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭.৪২% এবং মোট কার্গো থ্রুপুটে ৩.১১% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়ে এ সময়ে- দুটোই বন্দরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, পরিবহন ধর্মঘট ও কাস্টমস কার্যক্রমে নানা বাধা সত্ত্বেও জাহাজের গড় অপেক্ষার কাল ক্ষেত্রবিশেষে কমে এসেছে মাত্র, যা বন্দর ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
রাজস্ব ও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চবক বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় আর্থিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী অগ্রগতি অর্জন করেছে। মোট রাজস্ব আয় ৮.২২% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,২২৭.৫৫ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের ৪,৮৩০.৩৭ কোটি টাকা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। যদিও ব্যয় ৯.৪৫% বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২,৩১৪.৮৬ কোটি টাকা, তারপরও বন্দর রাজস্ব উদ্বৃত্তে ৭.২৭% প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে; ২,৭১৫.৩৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে উঠেছে ২,৯১২.৬৯ কোটি টাকায়। এ অর্জন প্রতিষ্ঠানটির শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্ব উৎপাদনের সক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে।
জাতীয় কোষাগারে উল্লেখযোগ্য অবদান
গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারের রাজস্ব খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এই সময়ে জাতীয় কোষাগারে মোট ৭,২০৩.০৬ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে, যা ক্রমবর্ধমান হারে প্রতিবছর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১,৭৬৫.২৬ কোটি টাকা প্রদান করে চবক নিজেকে সরকারের অন্যতম বৃহৎ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ
মানবসম্পদ উন্নয়নে দীর্ঘদিন পর, ২০২৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি বড় ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় বন্দরের ৩৬৫টি শূন্য পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং জানুয়ারি ২০২৫ থেকে আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত ৯১৬ জন বিদ্যমান কর্মচারীর পদোন্নতি- দুটি উদ্যোগই বন্দরের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়া, কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোর্ট টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গঠনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে অপারেটর ও কারিগরি কর্মীদের আন্তর্জাতিক মানে দক্ষ করে তোলা হবে, যাতে তারা বাংলাদেশের বন্দর খাতের কার্যকর নেতৃত্ব হাতে নিতে সক্ষম হয়।
টেকসই কল্যাণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি সমাজসচেতন ও মানবকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছে। বন্দরের কর্মী ও আশেপাশের জনগোষ্ঠীর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি কলেজ এবং একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করে আসছে।
নারী কল্যাণে ‘সিপিএ মহিলা সংঘ’ পরিচালিত ‘ঘাসফুল প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘নতুন কুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন’ নারী সম্পৃক্ততা ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত বন্দর হাসপাতাল বন্দরের কর্মী ও স্থানীয় জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে।
‘পোর্ট রিপাবলিক ক্লাব’ বছরের নানা সময়ে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে কম্যুনিটির মধ্যে সমপ্রীতি এবং অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাচ্ছে। ধর্মীয় সমপ্রীতির জন্য চবক মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয় নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে।
এছাড়া, কর্মীদের অনুপ্রাণিত রাখতে বার্ষিক প্রণোদনা বোনাস প্রদান করা হচ্ছে, যা বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক এবং দায়িত্বশীলতার বহিঃপ্রকাশ।
আজ বহুমাত্রিক প্রকল্প দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। যেমন বে-টার্মিনাল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি), নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে ১৭ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষে, গত ৭ জুলাই ২০২৫-এ চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড (সিডিডিএল)-এর কাছে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
গ্রিন চ্যানেল ও মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের মাধ্যমে
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি আধুনিক ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই অঞ্চলে বন্ডেড গুদামজাতকরণ, মূল্য সংযোজন কার্যক্রম ও উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হবে, যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা আরও জোরদার হবে। এছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকীকরণ, ই-গেট পাস ও অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু।
ডিজিটাল রূপান্তর ও অটোমেশনসহ কৌশলগত পুনর্গঠন ও মাস্টার প্ল্যান
গ্রিন মেরিটাইম সেক্টর ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক সংযুক্তি, ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বমানের সমুদ্র বন্দর, বন্দরের জমির সর্বোত্তম ব্যবহার, পোর্ট-টু-পোর্ট, বা বন্দর থেকে বন্দর সহযোগিতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর সঙ্গে সরাসরি শিপিং লাইন স্থাপন এবং যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চট্টগ্রাম বন্দর।
আমরা কাঠামোগত সংস্কার ও আধুনিকীকরণ, স্যাটেলাইট বন্দর শহর উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, অব্যাহত কল্যাণমূখী কার্যক্রম করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) জন্য গত বছরটি ছিল শুধু অগ্রগতিরই নয়, বরং এক রূপান্তরের বছর। এ সময়ে বন্দরের স্থিতিস্থাপকতা, আধুনিকায়ন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব আরো সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। রেকর্ড ভাঙা কার্গো হ্যান্ডলিং, বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পসহ দূরদর্শী অবকাঠামোর বিকাশ, এই বন্দরকে শুধু একটি বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার কৌশলগত চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি।
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক ভারসাম্য এবং পরিচালনগত উৎকর্ষতা ধরে রেখেছি। ডিজিটাল রূপান্তর, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও আধুনিক সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নিজের ভেতরেই এক নতুন দক্ষতা ও গতিশীলতার অধ্যায় সূচনা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে বাংলাদেশের সামুদ্রিক খাতকে সংযুক্ত করি নিবিড় ও কার্যকরভাবে। নেতৃত্বের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও অগ্রণী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আজ বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক যুগের পথপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি নেতৃস্থানীয় অবস্থানে উঠে আসার; আর তার সেই স্বপ্নেরই এক বিশুদ্ধ প্রতিফলন চট্টগ্রাম বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে বন্দর চেয়ারম্যানের সুদক্ষ নেতৃত্বে চলমান অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর- আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক দক্ষ, অধিক স্বচ্ছ, আরো জবাবদিহিমূলক এবং আরো বেশি উচ্চাভিলাষী।
আগামী দিনের প্রত্যাশা— কেবল প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করাই নয়, বরং একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উদ্ভাবননির্ভর সামুদ্রিক অর্থনীতি নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি বিশ্বমানের বাণিজ্যিক শক্তিতে পরিণত করা।
ধন্যবাদ আপনাকে
আপনাকেও ধন্যবাদ