নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ১৩, ২০২৫, ১২:০৪ এএম
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুর্নীতির অভিযোগে ক্রোক করেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত দুদক দেশে প্রায় এক হাজার ৪৫৩ একর জমি, ৭২টি বাড়ি, ১৪০টি ফ্ল্যাট, সাতটি ভবন, ৪০টি প্লট, ১০টি দোকান, ২৩৩টি গাড়ি, একটি ট্রাক, তিনটি জাহাজ, একটি অফিস স্পেস ও একটি পার্ক ক্রোক (অ্যাটাচ) করেছে। আর বিদেশে ৫৮২টি বাণিজ্যিক স্পেস ক্রোক করা হয়েছে।
তাছাড়া চার হাজার ৯৬০টি ব্যাংক হিসাব, ১৭টি সঞ্চয়পত্র, বিপুল পরিমাণ শেয়ার, ১৯টি বিও হিসাব, তিনটি বীমা পলিসি, নগদ অর্থ, সোনা, বিদেশি মুদ্রা অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করেছে। ক্রোক করা সম্পদ নিয়ম অনুযায়ী দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণ করে।
কিন্তু জনবলের অভাবে বর্তমানে জব্দকৃত এতো বিপুল সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দুদক। দুর্নীতি দমন কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুর্নীতির অভিযোগে জব্দ স্থাবর সম্পদ ক্রোক করার তা থেকে আয় হওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট মালিকের পরিবর্তে রাষ্ট্র পায়। সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের মাধ্যমে দুদক। ওসব সম্পদের ব্যবস্থাপনা করে। দুদকের ওই ইউনিট দুদক সচিবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। বর্তমানে একজন পরিচালক, দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালক ও একজন উপসহকারী পরিচালক দিয়ে সংস্থাটির সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট চলছে।
তাছাড়া ওই ইউনিটে একজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, একজন অফিস সহায়ক, দুজন এএসআই ও একজন পিএ কর্মরত রয়েছেন। আর এতো অল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, গত এক বছরে দুদক মোট ২৩৩টি গাড়ি ক্রোক করে দুদক। কিন্তু ওসব গাড়ির জন্য কোনো রিসিভার নিয়োগ করা হয়নি। আবার রিসিভার নিয়োগ করা গাড়িরও হদিস মিলছে না। গত ১৩ জানুয়ারি দুদকের মামলায় একটি গাড়ির (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-৩৫-৩৭০৭) রিসিভার নিয়োগ করা হয়। কিন্তু গাড়িটি দুদক এখনো বুঝেই পায়নি। ক্রোক করা ২৩৩টি গাড়ির মধ্যে ১৫৩টি বাস ও একজন সাবেক সংসদ সদস্যের ১৬টি গাড়িও রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণে এখনো রিসিভার নিয়োগ না হওয়ায় ওসব গাড়ির আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে না।
যদিও ১৫৩টি বাসের রিসিভার নিয়োগের বিষয়ে কমিশনে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আবেদন করেছেন। কিন্তু ওই কর্মকর্তা এখনো এ বিষয়ে আদালতের আদেশ পাননি। গত ১২ জানুয়ারি সাবেক এক সংসদ সদস্যের জমি, ফ্ল্যাটসহ ৪৫টি স্থাবর সম্পত্তি ও ১৬টি গাড়ি ক্রোক করা হয়। তাছাড়া ১৯টি ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় ৫৭ কোটি ও যৌথ মালিকানাধীন চার কোম্পানির ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়। কিন্তু ১৬টি গাড়ি ক্রোকের পর কোথায় রাখা হয়েছে দুদকের কাছে ওই তথ্য নেই।
সূত্র আরও জানায়, দুদকের অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করে সম্পদের সঠিকতা যাচাই করে তারপর ক্রোকের জন্য আবেদন করার কথা। তাছাড়া ওই কর্মকর্তারই রিসিভার নিয়োগের জন্য আবেদন করার কথা। তাছাড়া সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট তো রয়েছেই। কিন্তু তারপরও কীভাবে ওসব সম্পদ রিসিভার নিয়োগের বাইরে রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রোক করা সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে দুদক নীতিমালা তৈরি করছে।
যদিও ফ্রিজ বা ক্রোক আদেশের ক্ষমতা তদন্তকারীর হাতে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আদালত থেকে আদেশ আনতে আনতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে ব্যাংকের টাকা অপরাধীরা সরিয়ে ফেলে। ফ্রিজ ও ক্রোকের মেয়াদও বাড়ানো জরুরি। সাধারণত অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হলে ছয়-সাত মাস পরে আনফ্রিজ হয়ে যায়।
এদিকে দুদক বিধিমালায় (সংশোধিত, ২০১৯) বলা হয়েছে, স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হলে আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠাতে হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা লকার অবরুদ্ধ করা হলে তার নির্দেশ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে পাঠাতে হবে। শেয়ার, ডিবেঞ্চার বা স্টক ক্রোক করা হলে তার লভ্যাংশ হস্তান্তর ও লেনদেন নিষিদ্ধ করে তার আদেশ সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং প্রয়োজনে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কাছে পাঠাতে হবে। যানবাহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ পাঠাতে হবে, যেন তারা সেটির ব্যবস্থাপনা করতে পারেন।
অন্যদিকে এ বিষয়ে দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট সংশ্লিষ্টদের মতে, জব্দ সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। রিসিভার নিয়োগ করা বাসার ভাড়া সেখানকার সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে আদায় করা হয়। আগামীতে ফাঁকা বাসাগুলো গণপূর্ত দিয়ে পরিমাপ করা হবে, তারপর ভাড়া দেয়া হবে। বিধি অনুযায়ী ক্রোক করা সম্পদ ব্যবস্থাপনা বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিসিভার নিয়োগ করা হয়। আদালতের আদেশেই ক্রোক ও রিসিভার নিয়োগ করা হয়। দুদক অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব আবেদন করেন।