ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Amar Sangbad

ইনস্টাগ্রাম

Amar Sangbad

এক্স

Amar Sangbad


লিংকডইন

Amar Sangbad

পিন্টারেস্ট

Amar Sangbad

গুগল নিউজ

Amar Sangbad


হোয়াটস অ্যাপ

Amar Sangbad

টেলিগ্রাম

Amar Sangbad

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Amar Sangbad


ফিড

Amar Sangbad

ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই, ২০২৫
Amar Sangbad

বড় স্বপ্নে দুর্বল সামর্থ্য

আবদুর রহিম ও রেদওয়ানুল হক

আবদুর রহিম ও রেদওয়ানুল হক

জুলাই ২৮, ২০২২, ১২:৫৯ এএম

বড় স্বপ্নে দুর্বল সামর্থ্য

হারিছ চৌধুরী। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন। মাসে বেতন ১৮ হাজার। দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে চলছে সংসার। তিন বছর আগে বড় মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে এমপিওভুক্ত হয়ে একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। মেঝো মেয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। ছোট ছেলে একাদশ শ্রেণিতে। এর মধ্যে ছোট ছেলের বায়না। করতে হবে স্বপ্ন পূরণ। কিনে দিতে হবে নতুন ব্র্যান্ডের মোবাইলফোন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩২ হাজার টাকা। ছেলের স্বপ্ন পূরণে মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটছে হারিছের।

এদিকে ভালো নেই স্কুলশিক্ষক মাস্টার জিলানী। তিনি ফেনী সদর উপজেলার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকতা জীবন শেষে অবসরে রয়েছেন। এক ছেলে সরকারি চাকরি করছেন, আরেক ছেলে সমপ্রতি সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট ছেলের বায়না এখন আর গ্রামের স্কুলে পড়বে না। করতে হবে স্বপ্ন পূরণ! শহরের দামি স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। স্বপ্ন দেখা স্কুলের পড়াশোনা ও গ্রামে পড়া স্কুলের পড়াশোনার মান একই অবস্থানে, এটি বোঝাতে কোনোভাবেই সক্ষম হচ্ছেন না স্কুলশিক্ষক। বাড়ির পাশে সামর্থ্যবান দুই পরিবারের সন্তানরা দামি স্কুলে ভর্তি হয়েছে, এখন ওকেও করাতে হবে। এ নিয়ে পারিবারিক জ্বালায় তিনি।

সরকারি কর্মকর্তা আবিদ হাসানের ঘরে আরো বেশি যন্ত্রণা। বাড়ি আছে , গাড়ি আছে। তবুও স্ত্রী-সন্তানের শখ আরেকটি দামি গাড়ি ও দেশের বাইরে বাড়ি কেনার। ক্ষোভের ইঙ্গিত দিয়ে সমপ্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন স্ট্যাটাস।

লিখেন, ‘আমি অনেকের চেয়ে ভালো তবুও আমার সামর্থ্যের সীমানা ছাড়িয়েছে। আমার স্ত্রী-সন্তানের স্বপ্ন বড় হয়েছে কিন্তু আমার বেতনকাঠামো বড় হয়নি।  একটি বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে কিন্তু স্বপ্নের সাথে এখন মিলছে না।’

দেশের নাগরিক সমাজ বলছে, পরিবেশের সাথে সাধ্য মেটানো দায় হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম স্বপ্নের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবতায় নিজের সাথে মেলাচ্ছে না। প্রযুক্তি প্রচারণায় বিলাসী জীবন নিয়ে বেশি স্বপ্ন দেখছে। চাওয়া চাহিদায় মারাত্মক হার বেড়েছে।

পরিবারে অতিরিক্ত খরচ ও চাপ বেড়ে গেছে। আয়ের সাথে ব্যয় মেলানো যাচ্ছে না। সন্তানদের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ঘরে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এখনই রাষ্ট্র থেকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিলে মহামারির আশঙ্কা রয়েছে বলে দাবি উঠেছে।

তবে অর্থনৈতিক সেক্টর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিলাসপণ্যের প্রতি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কয়েকগুণ দাম বাড়িয়েও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অপচয়সহ অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে রাষ্ট্র থেকে নানাভাবে বার্তা পাঠানো হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে ফেনীর নূর উদ্দিন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবা প্রবাসী ছিলেন। এক সময় ভালো অবস্থানে ছিলেন। আমরাও চাহিদামতো সব পেয়েছি। করোনার সময় বাবা দেশে এসে আর যেতে পারেননি। এখন আমাদের সংসারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আয় কমেছে কিন্তু প্রয়োজনীয়তা কমেনি। ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছে।

তার জন্য কেনা লাগছে উন্নতমানের মোবাইল। যা বাবার এক মাসেরও বেশি বেতনের সমান। অন্যদিকে সংসারের খরচ কমানো যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত যুগের সাথে আমাদের স্বপ্ন বড় হচ্ছে, প্রয়োজন বাড়ছে, কিন্তু সামর্থ্যে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

সমপ্রতি দামি গাড়ি, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স, স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান ধাতু ও মুক্তা, তৈরি পোশাকসহ বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এসব পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকরা ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণসুবিধা পাবেন না। গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ নির্দেশনা পাঠানো হয়।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরকার (সেডানকার, SUV, MPV ইত্যাদি),  ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স, স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান ধাতু ও মুক্তা, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, প্রসাধনী, আসবাবপত্র ও সাজসজ্জা সামগ্রী, ফল ও ফুল, নন সিরিয়াল ফুড যেমন— অশস্য খাদ্যপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়; যেমন টিনজাত (Canned) খাদ্য, চকোলেট, বিস্কুট, জুস, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি, অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়, তামাক, তামাকজাত বা এর বিকল্প পণ্যসহ অন্যান্য বিলাসজাতীয় পণ্যের আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। যদিও এর আগে যথাক্রমে ২, ৫০ ও ৭৫ শতাংশ মার্জিন সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। তবে দেশে ডলার সঙ্কট তৈরির আগে এ ধরনের কোনো শর্ত ছিল না।

সামপ্রতিক আর্থিক সূচকগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিলাসী পণ্যের চাহিদার বিপরীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সক্ষমতা বা রপ্তানি আয়ের সামঞ্জস্য কোনোটাই তৈরি হয়নি। প্রযুক্তির ছোঁয়া, ভিনদেশী সংস্কৃতি চর্চার মানষিকতা, আলট্রা মডার্ন প্রজন্ম তৈরি, দেশের ইংরেজি মাধ্যম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসুস্থ আধুনিকতার চর্চা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় একটি উচ্চাবিলাসী প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। যারা বিলাসী পণ্যের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে উচ্চাবিলাসী প্রজন্ম হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের চাহিদা এখনো জাতীয় সংকটে প্রভাব ফেলার মতো অবস্থায় যায়নি। কিন্তু গত এক দশকে দেশে অবৈধ দুর্নীতগ্রস্ত একটি শ্রেণির আধিক্য দেখা দিয়েছে।

যারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এসব শ্রেণির চাহিদা অস্বাভাবিক। তারা অতিমাত্রায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন। যেমন— কয়েকগুণ বেশি দামে গাড়ি ক্রয় থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনার মতো জিনিসে তারা মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে।

আর এ সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা। যদিও এ শ্রেণিতে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ আছে। কিন্তু তাদের চাহিদা মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংক খরচ হচ্ছে। সামপ্রতিক কোটিপতি ব্যাংক হিসাব বৃদ্ধির হার পর্যালোচা করলে এ শ্রেণিটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।  

গত ২২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে কমপক্ষে এক কোটি টাকা আছে এমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৯ হাজার ৩২৫টি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অন্তত এক কোটি টাকা রয়েছে— এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৫৯৭টি, যা ২০২১ সালের মার্চ শেষে ছিল ৯৪ হাজার ২৭২টি।

২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষে কোটি টাকা রয়েছে— এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টি। অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতির হুমকি সত্ত্বেও ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ৬২১টি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এক কোটি টাকার বেশি আছে— এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি।

এই অল্প সংখক এবং দ্রুত ধনী হওয়া পক্ষটির উচ্চাবিলাসী জীবনধারাই দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। একই সাথে সামাজিক বৈষম্য তৈরি করছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আমার সংবাদকে বলেন, ‘কিছু লোকের কারণে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।

বিলাসী পণ্য আমদানির কারণে যে চাপ তৈরি হয়েছে তার জন্য একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী দায়ী। তাদের উচ্চাবিলাসী জীবনধারণের জন্য দেশে চাহিদা ও সক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে।’এ গোষ্ঠীটি সামাজিক বৈষম্য তৈরি করেছে। যার ফলে একটি অসম সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে বলা যায় গরিবের ঘোড়া রোগ হয়েছে। বাংলাদেশের মন্ত্রী-আমলারা পাজেরো-প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করেন। যেখানে এখনো সাধারণ মানুষ খাবারের জন্য লড়াই করে। এসব উচ্চবিত্তদের বিদেশি সাবান, পারফিউম ছাড়া চলে না। তাদের অবস্থা দেখলে মনে হয় সন্তানরা চাইলেই সব দিতে হবে। সবার জন্য গাড়ি, দামি খেলনা, বিদেশি প্রসাধনী ছাড়ার এদের চলে না। এরাই সমাজ ও অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করছে।’ পুঁজিবাদি শাসন ব্যবস্থার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন এ সমাজবিজ্ঞানী।

তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি সার্ভে করেছি। তাতে দেখা গেছে, কারো একক আয়ে ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানকে পড়ালেখা করানো সম্ভব নয়। কিন্তু গুটিকয়েক হঠাৎ ধনী হওয়া গোষ্ঠীর সন্তানরা হয় ইংরেজি মাধ্যমে নয়তো বিদেশে পড়ালেখা করছে। মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থেই তারা বিলাসী জীবনযাপন করছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে অবাধ দুর্নীতির সুযোগের কারণে।’

রাষ্ট্রের নিয়মনীতি পুঁজিবাদ ও ধনীদের পক্ষে হওয়ায় যে যেভাবে পারছে সেভাবেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করছে বলে মনে করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও সামাজিক সংগঠক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘মুষ্টিমেয় ভোগবাদী গোষ্ঠী সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে। উন্নত বিশ্বে গাড়িসহ বিলাসী পণ্যে অধিক শুল্ক থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিসহ নানা সুবিধা ভোগ করছে এ গোষ্ঠীটি। তাদের সন্তানদের আলট্রা-মডার্ন লাইফস্টাইল সমাজ জীবনে ব্যবধান তৈরি করছে।’

এ সমাজকর্মী বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটা সংখ্যা বিলাসী জীবনে উৎসাহিত হচ্ছে এটি ঠিক। তবে কিছু মানুষের চাহিদা এত বেশি যে সমাজ ও অর্থনীতিতে যা চাপ তৈরি করছে।

Link copied!