Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

১২৫ বছরের পুরোনো ওয়ারী ক্লাব ধু্ঁকছে অর্থাভাবে

হারানো গৌরব ফেরানোই লক্ষ্য

আহমেদ হূদয়

আহমেদ হূদয়

সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:৫৫ এএম


হারানো গৌরব ফেরানোই লক্ষ্য
  •  অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন পরিকল্পনা
  • ১৯১০ সালে ক্লাবটি প্রথম সাফল্য পায়; ১৯১৯ সালে হারিয়েছিল মোহনবাগানকে
  • ক্রিকেট দলকেও এবার ফেরাতে চায়, আলোচনা চলছে বিসিবির সঙ্গে
  • শিগগিরই ১২৫ বছরপূর্তি উদ্যাপন করবে ক্লাবটি

চ্যাম্পিয়ন বা রানার্সআপ হওয়া লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায় থেকে খেলোয়াড় তুলে এনে জাতীয় দল ও লিগে তাদের খেলার ব্যবস্থা করা
—মহিদুর রহমান মিরাজ, সাধারণ সম্পাদক, ওয়ারী ক্লাব

বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলকে কতটা ভালোবাসে, ফুটবলের প্রতি তাদের কতটা আবেগ— এসব প্রশ্ন করার হয়তো কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, শুধু বাংলাদেশিরাই নন; সারা বিশ্বের মানুষই এখন জানে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলপ্রীতির কথা। একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশের ক্লাব ফুটবল ছিল খুবই জনপ্রিয়। এখনো অনেক জনপ্রিয়।

যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো স্পোর্টিং ক্লাব কোনটি? আপনার মাথায় হয়তো তখন মোহামেডান, আবাহনী কিংবা ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কথাই ঘুরপাক খাবে। কিন্তু আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরোনো ক্লাব হচ্ছে ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাব। রঙ তার লাল-সাদা, স্লোগানে অভিনবত্ব— ‘এক হূদয় এক মন’। ব্রিটিশ আমলে ফুটবল খেলায় ফরিদপুরের ভাদুড়ি পরিবারের খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। এ পরিবারেরই এক কৃতী সন্তান রামদাস ভাদুড়ি ঢাকার ওয়ারী এলাকায় ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ক্রীড়া সংগঠন, যার নাম ছিল ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’। দীর্ঘদিন চলার পর একসময় সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওয়ারীর কয়েকজন ক্রীড়া সংগঠক এই ওয়েলিংটনকেই ‘ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাব’ নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার প্রথম ফুটবল ক্লাব; সেই ১৮৯৮ সালে।

হঠাৎই ক্যাসিনো কাণ্ডে বন্ধ হয়ে যায় ক্লাবগুলো। তবে বন্ধ ছিল না ওয়ারী ক্লাবও। হাউজিসহ কিছু আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যায় ওয়ারী ক্লাবের। তার মধ্যে আবার করোনার হানা। সব মিলিয়ে অর্থের অভাবে ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবটি। 

করোনার আগে ক্রিকেট দলও বন্ধ হয়ে যায়। তবে নতুন করে আবারও ক্লাবটির সেই হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ক্লাবকর্তারা। 

একান্ত আলাপকালে ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মহিদুর রহমান মিরাজ আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের ওয়ারী ক্লাব কখনোই বন্ধ ছিল না। আমরা নিয়মিতভাবেই সবগুলা খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। তবে ক্লাবপাড়ার ক্লাবগুলো বন্ধ থাকায় যে প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, সেই ধাক্কা ওয়ারী ক্লাবেও লেগেছে। তবুও গত তিনটি মৌসুমে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে (বিসিএল) আমরা অংশগ্রহণ করেছি। দল হিসেবে ফলাফল আমাদের আশানুরূপ ছিল।   

ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে ক্রীড়া শুধুই বিনোদন ছিল না, ছিল আত্মমর্যাদা ও লড়াইয়ের প্রতীকও। ওয়ারী ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যও এসবের বাইরে ছিল না। এলাকার অভিজাতদের আড্ডার মূল জায়গা ছিল ক্লাব চত্বর, ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের মান-মর্যাদাও। তাই যে কোনো খেলায় সেরা দল গড়তে দুই হাতে পয়সা খরচ করতেন তারা। অন্যসব খেলার চেয়ে ফুটবলই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে সম্প্রতি অর্থের অভাবে ধুঁকছে ক্লাবটি। তাদের আয়ের উৎসগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। 

মহিদুর রহমান মিরাজ বলেন, অন্যান্য ক্লাব বন্ধ থাকায় আমাদের আয়ের উৎসগুলোও প্রায় বন্ধ ছিল। যেমন হাউজি, অভ্যন্তরীণ খেলা— এগুলো থেকে ক্লাবের ব্যয়ের সিংহভাগ আমরা আয় করতাম।  শুধু কী ফুটবল! ওয়ারী ক্লাব ভলিবল, টেবিল টেনিস এবং হকিতেও শক্ত প্রতিপক্ষ। 

ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ভলিবল প্রিমিয়ার লিগে আমরা টপ লেভেলে খেলছি। তবে আমাদের হকি দল প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয়েছে। আমাদের ক্লাবের খেলা বন্ধ ছিল না। করোনার মধ্যে টেবিল টেনিসের দুটি মৌসুমে আমরা অংশগ্রহণ করেছি। দুটির মধ্যে একটিতে রানার্সআপ এবং একটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। 

বাংলাদেশের ক্রিকেট লিগেও নিয়মিত দল ছিল ওয়ারী ক্লাব। তবে হঠাৎ করে ক্রিকেট দল আর নেই। তবে খুব শিগগিরই ওয়ারী ক্লাবের ক্রিকেট দলও ফিরবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক। 
ক্রিকেট নিয়ে তিনি বলেন, ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে। বিসিবির শীর্ষস্থানীয় কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের ওয়ারী ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা পল্টু সাহেব বিসিবি সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছেন। ক্রিকেট বোর্ডের কোয়ালিফাইং যে টুর্নামেন্টটা হয়, সেটা যে সময় অনুষ্ঠিত হয়, সে সময় ওই টুর্নামেন্টে খেলার জন্য তারা আমাদের আহ্বান জানিয়েছিল। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি যেন ওই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে আমরা আবারও খুব দ্রুত ক্রিকেটে ফিরে আসতে পারি। 

মিরাজ আরও বলেন, চ্যাম্পিয়ন বা রানার্সআপ হওয়া লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য হলো তৃণমূল পর্যায় থেকে খেলোয়াড় তুলে এনে জাতীয় দল ও লিগে তাদের খেলার ব্যবস্থা করা। কাজটি স্বাধীনতার পর থেকেই করে আসছি, ভবিষ্যতেও আমরা করব। আশা করি আমরা সফল হব এবং  আমাদের দল হারানো গৌরব ফিরে পাবে।

শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট, ভলিল, টেনিসেও যেন আমাদের ক্লাবের খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে খেলতে পারে— সেদিক থেকেও আমরা বোর্ডগুলোকে সহযোগিতা করব। খেলোয়াড় তৈরি করাই হচ্ছে আমাদের মূল উদ্দেশ্য। 
তিনি বলেন, করোনাকালীন সময় থেকে আমাদের যে ধাক্কা লেগেছে, তা আমরা খুব শিগগিরই কাটিয়ে উঠতে পারব ইনশাআল্লাহ। আর আমাদের ক্লাবের কিছু মেরামতের কাজ রয়েছে, কারণ করোনার সময়ে আমরা দীর্ঘ সময় ক্লাবে আসতে পারিনি। তাই আমরা কিছু মেরামতের কাজ করব। আর খুব শিগগিরই ক্লাবের ১২৫ বর্ষপূর্তির আয়োজন করব। 

সামনের মাসেই ফুটবলের জন্য দল তৈরি করবে ওয়ারী ক্লাব। কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথাও হয়েছে। গতবারের ডে টিম ছিল; সেখান থেকে প্রায় ১০ জন ফুটবলার প্রিমিয়ার লিগের বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে।      
ওয়ারী ক্লাবের প্রথম সাফল্য আসে ফুটবলে, ১৯১০ সালে। সে বছর ওয়ারী ক্লাব পরাজিত করে ব্রিটিশ রাজকীয় ‘প্রাসাদ’ দলকে। এ জয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশের ফুটবলরসিকদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় ওয়ারী ক্লাব। এরপর ১৯১৭ সালে তৎকালীন লিগ চ্যাম্পিয়ন লিংকলিন ক্লাবকে হারিয়ে সবাইকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয় ক্লাবটি। এর বছর দুয়েক পরই আরেকটি বড় সাফল্য পায় ওয়ারী ক্লাব। 

১৯১৯ সালে তারা হারিয়ে দেয় মোহনবাগান ক্লাবকে! যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন মোহনবাগান শুধু বাংলা নয়, ভারত উপমহাদেশেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব। ২-১ গোলে জেতা সে ম্যাচটি তাই ওয়ারী ক্লাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন অনেকেই। ১৯২৫ সালে ভারত সফরে এসেছিল ইংল্যান্ডের ক্লাব ‘শেরউড ফরেস্ট’। অনেক ভালো ফুটবল খেলেও ওয়ারী সেবার ২-১ গোলে হেরে যায়। তবে ওয়ারী ক্লাব শেরউডের জালে একবার হলেও বল ঢোকাতে সক্ষম হয়, যা পারেনি উপমহাদেশের অন্য কোনো দল। বিশ্বখ্যাত কোরিনথিয়ান্স ফুটবল দল উপমহাদেশে সব সময় অপরাজিত থাকত। ১৯৩৭ সালে তাদের হারিয়ে দেয় যে ঢাকা একাদশ দল, সেই একাদশের ১০ জন খেলোয়াড়ই ছিলেন ওয়ারী ক্লাবের। 

প্রতিষ্ঠার পর ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও একসময় পাঁচটি আলাদা খেলায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে ওয়ারী। ফুটবল, হকি, ভলিবল, ক্রিকেট এবং টেবিল টেনিস। একে একে সাফল্য এসেছে প্রায় প্রতিটি খেলায়ই। ১৯৫৩ সালে ওয়ারী হকি দল লিগ শিরোপা জয়লাভ করে। সে বছর কলকাতায় খেলতে গিয়ে সেখানকার লিগজয়ী মোহনবাগান হকি দলকে পরাজিত করে ৩-১ গোলে। এরপর হকিতে নানা সময়ে লিগ জিতেছে ওয়ারী। হকির মতোই টেবিল টেনিসেও এসেছে নিয়মিত শিরোপা। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান লিগে ক্লাবের খুরশিদ আনোয়ার ও আনোয়ার সামাদ হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। 

টেবিল টেনিসের মতোই ওয়ারী ভলিবল দল সব সময় শক্তিশালী ছিল। তাই তাদের সাফল্যও এসেছে অনেক। ওয়ারীকে বলা হতো ভলিবল প্লেয়ার তৈরির কারখানা। ৬০ ও ৭০ দশকে নিয়মিত লিগবিজয়ী হতো ভলিবল দল। ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে তারা। ক্রিকেটেও ক্লাবটির সাফল্য কম নয়। জাতীয় লিগে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের রেকর্ড রয়েছে তাদের। বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা অনেক খেলোয়াড় উঠে এসেছে এ ক্লাব থেকে।
 

Link copied!