Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৬ জুন, ২০২৫,

এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটিতে খালি হচ্ছে ঢাকা

বাসায় চুরি, পথে ডাকাতির শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুন ৫, ২০২৫, ১২:২৫ এএম


বাসায় চুরি, পথে ডাকাতির শঙ্কা

এবার ঈদুল আজহায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও টানা ১০ দিনের ছুটি কাটাবেন। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে লাখ লাখ মানুষ রাজধানী শহর ছেড়ে নাড়ির টানে ছুটে চলেছেন বিভিন্ন গন্তব্যে। ফলে তাদের শহরের বাড়িঘর, ফ্ল্যাট ও অফিস জনশূন্য হয়ে পড়ছে। এ কারণে দীর্ঘ ছুটিতে ঈদ আনন্দের পাশাপাশি নানারকম শঙ্কাও ভর করেছে জনমনে। 

ঈদের দীর্ঘ ছুটির সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। বাসচালক, স্টাফদের মাঝে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। 

তারা আশঙ্কা করছেন, মহাসড়কে প্রশাসনের বাড়তি নিরাপত্তা না থাকলে যাত্রী ও চালকদের ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহাসড়কে বেশকিছু ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এমনকি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আটকে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত ও বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। 

পুলিশ বলছে, তিনটি পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যেমন ঈদ পূর্ববর্তী, ঈদের সময় ও ঈদ পরবর্তী। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেড় কোটি মানুষ এবার ঈদে ঢাকা ছাড়বে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। 

মহাসড়কের বাসচালকরা অভিযোগ করেছেন, প্রায়ই মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। কক্সবাজারের চকরিয়া, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, যমুনা সেতু, টাঙ্গাইল হাইওয়েসহ বিভিন্ন জায়গায় যাত্রীবেশে অথবা বাস থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মহাসড়কে তেমন দেখা যায় না। মাঝে মাঝে মহাসড়কে দেখা গেলেও লক্ষ্য করা যায়, তারা এক জায়গায় দীর্ঘ সময় বসে আছেন। 

অথচ হাইওয়ে পুলিশের সদস্যদের সব সময় সড়কে টহলের উপরে থাকার কথা। তাদের ডিউটির গাফিলতির কারণে প্রায় সময় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বাসচালকরা।  

এনা পরিবহনের চালক মো. আবুল কাশেম জানান, তিনি মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে কক্সবাজার ও সিলেট জেলায় শিফটিং অনুযায়ী দিনেরাতে যাত্রী বহন করে থাকেন। মহাসড়কে প্রায় সময় বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। 

এটির কারণ তিনি মনে করেন, সড়কে পুলিশ উপস্থিতি খুবই কম। পুলিশকে মাঝে মাঝে সড়কে দেখা গেলেও তারা দলবদ্ধভাবে সড়কের কোনো কোনো দোকানের সামনে দীর্ঘ সময় চা পানে ব্যস্ত থাকে। অথচ পুলিশের নিয়ম হচ্ছে, সব সময় চলমান টহলের ওপর থাকা। তাদের এই অবহেলার কারণেই হাইওয়েতে বাসে ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে। 

অনেক সময় দেখা যায়, চলন্ত বাসে ঢিল মারছে ও বাসের চাকা লক্ষ্য করে নানারকম জিনিস ছুড়ে মারা হচ্ছে। এগুলো পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঈদযাত্রায় মহাসড়কে ডাকাতির আতঙ্কে আছেন জানিয়ে এই চালক বলেন, চালক হিসেবে সবার আগে যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে হয় আমাদের। কারণ আমাদের রুটি-রুজি তাদেও দিয়ে। 

রাজধানীর মহাখালী থেকে সিলেটগামী বিলাস পরিবহনের চালক মো. সোবহান মিয়া বলেন, শুধু ঈদে নয়, গত ৯-১০ মাস যাবত ডাকাত আতঙ্কে আমাদের থাকতে হচ্ছে। প্রায় সময় মহাসড়কে বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। পুলিশের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি মহাসড়কের চলাচলকারী যেকোনো বাসে নিরাপত্তার জন্য কেচিগেট ব্যবহার করা উচিত।  

হস্তশিল্প ব্যবসায়ী খিলগাঁও এলাকার ভাড়াটিয়া শরিফুল ইসলাম বলেন, নাড়ির টানে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে জামালপুর যেতে হবে। বাড়ি যাওয়ার আগে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বর্তমান ঠিকানার বাসা তালাবদ্ধ করে যেতে হয়। গণমাধ্যমে প্রতিদিনই চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনার খবর পাই। আর ঈদে খালি বাসায় চুরির ঘটনা একটু বেশি হয়ে থাকে। তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ার পরও বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে চিন্তায় আছি। তবুও বাড়ি যেতে হবে। 

পুরান ঢাকার একটি কারখানায় কর্মরত বিলকিস আক্তার নামে এক শ্রমিক বলেন, বোনাস পেয়েছি, ৪ জুন বেতন পাব। সেই বেতন নিয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশে রওনা দেব। মানুষজনের কাছে শুনছি, বাসে ডাকাতি হয়। অজ্ঞান পার্টি ও চুরি-ছিনতাই অনেক বেড়ে গেছে। আমি আতঙ্কে আছি। যদি আমার টাকা ছিনিয়ে নেয়, আমি তো টাকা হারানোর শোকে মরেই যাব!  

দেশের অধিকাংশ মহাসড়কে ছোট বড় ডাকাতির ঘটনা ঘটেই চলছে। ডাকাতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সও। চলতি বছরের মে মাসে টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে একটি যাত্রীবাহী বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় একটি ডাকাতদল। 

ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে আল ইমরান পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস রংপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। যেতে যেতে পথে অনেক যাত্রীকে তোলা হয় বাসটিতে। বাসে থাকা যাত্রীবেশী ৮-১০ জন ডাকাত জিম্মি করে বাকি যাত্রীদের কাছ থেকে সবকিছু লুটে নেয়। কয়েক ঘণ্টা ডাকাতরা বাসের ভেতরে তাণ্ডব চালায়। 

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এই মহাসড়কে ইউনিক রয়েলসের একটি বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালের ২ আগস্ট একই কায়দায় কুষ্টিয়াগামী একটি বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। 

অন্যদিকে ডাকাতদের খপ্পর থেকে পার পায়নি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। গত ২২ মে রাত একটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর বুড়িশ্বর ইউনিয়নের তিলপাড়ায় সড়কে গাছ ফেলে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতদল লাশের সঙ্গে থাকা স্বজনদের মারধর করে অর্ধলক্ষাধিক টাকা ও কয়েকটি মোবাইল ফোন লুটে নিয়েছে। এ সময় ডাকাতদের হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যারিকেড দিয়ে রামদা হাতে ডাকাতির চেষ্টার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। 

গত ৬ মে রাত ২টার দিকে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ওমপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চালকের দক্ষতায় ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পান ওই গাড়ির আরোহীরা। ঘটনার সময় গাড়ির একটি ড্যাসবোর্ড ক্যামেরায় পুরো ঘটনাটি রেকর্ড হয়। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। 

ভিডিওটিতে দেখা যায়, এক্সপ্রেসওয়েতে রাস্তা বন্ধ করে ওত পেতে থাকা ডাকাতরা একটি গাড়ি আসতেই বড় রামদা নিয়ে গাড়িটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু গাড়িচালক ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে না গিয়ে দ্রুত গাড়িটি নিয়ে কেটে পড়তে সমর্থ হন। 

গত ২৪ মে দিবাগত রাত দুইটার দিকে হবিগঞ্জ বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়কের কুন্ডুর পাড় এলাকার অদূরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রাস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটি ও গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ডাকাতরা পুলিশের গাড়ি জিম্মি করে কয়েকটা যানবাহনে ডাকাতি করে মালামাল লুট করে। ঘটনার পর এ বিষয়ে বানিয়াচং আজমিরীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রবাস কুমার সিংহ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ডাকাতরা পুলিশের গাড়িটি যাত্রী ভেবে আটকে দেয়। পরে পুলিশ সদস্যরা ডাকাতদের ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মহাসড়কের নিরাপত্তা এবার নড়বড়ে। প্রতিদিন মহাসড়কের কোথাও না কোথাও এমনিতেই ডাকাতি হচ্ছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকলে এবার ডাকাতের কবলে পড়ার আশঙ্কা আছে। আর লম্বা ছুটির কারণে ঢাকা থেকে ধাপে ধাপে মানুষ ঢাকার বাইরে যাবে। এবার ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ ঈদের সময় যার যার এলাকায় যাবে। লম্বা ছুটি হওয়ার কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। 

তিনি বলেন, এই ঈদে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। তাই শুধু তিন-চার দিনের জন্য নিরাপত্তা বাড়ালে হবে না। আরেকটি বিষয় হলো যেভাবে ছিনতাই হচ্ছে, তাতে ঈদে ঘরমুখী মানুষ বাসা থেকে বাস, রেল বা লঞ্চ টার্মিনাল পর্যন্ত নিরাপদে যেতে পারেন কি না, তাও আশঙ্কার বিষয়। পাশাপাশি অজ্ঞান পার্টি, প্রতারক দল, টানা পার্টি, মলম পার্টিসহ নানা ধরনের অপরাধীরা সক্রিয় রয়েছে। দেশের সড়ক মহাসড়কের নিরাপত্তায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের পাশাপাশি কমিউনিটি ট্রাফিক পুলিশ, বাংলাদেশ স্কাউট ও শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মাঠে সক্রিয় করার অনুরোধ জানান তিনি। 

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর বলেন, আমাদের মূলত তিনটি পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে- ঈদ পূর্ববর্তী, ঈদের সময় এবং ঈদ পরবর্তী। পবিত্র ঈদুল আজহা শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদে উদযাপনের লক্ষ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ সমন্বিতভাবে কাজ করছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কৌশলগত স্থানে চেকপোস্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, রাত্রিকালীন টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঈদযাত্রায় সবাই যাতে নিরাপদে এবং নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পারেন এবং ঈদ পরবর্তী সময়েও স্বস্তিতে কর্মস্থলে ফিরতে পারেন, সেজন্য মহাসড়কগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঈদের জামাতের নিরাপত্তায় আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। মোতায়েনকৃত পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি সাদা পোশাকে পুলিশ এবং গোয়েন্দা পুলিশ মাঠে কাজ করবে। ‘মানি এসকট’ সুবিধা যদি কেউ নিতে চাইলে তাহলে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং সিসিটিভি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করা হবে। জরুরি প্রয়োজনে ‘৯৯৯’ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।

তাছাড়া কন্ট্রোল রুমের নম্বর সমূহেও প্রয়োজনবোধে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ছাড়া পশুর হাটে নিরাপত্তার পাশাপাশি কোরবানির পশু আনা-নেয়ায় সড়কে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে আমাদের সাইবার পেট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে।

Link copied!