Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

রাবিতে প্রক্সির অভিযোগে দণ্ডিত

সেই ছাত্রলীগ নেতা ঢাবিতেও ছিলেন নানা অপকর্মের হোতা

ঢাবি প্রতিনিধি

ঢাবি প্রতিনিধি

জুলাই ২৯, ২০২২, ০৭:৪৬ পিএম


সেই ছাত্রলীগ নেতা ঢাবিতেও ছিলেন নানা অপকর্মের হোতা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় (মূল পরীক্ষার্থী লিমনের হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ) প্রক্সি দিতে গিয়ে গত ২৬ জুলাই এক বছর কারাদণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ নেতা মোঃ এখলাছুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও। তার আসল নাম মোঃ এখলাছুর রহমান হলেও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ‘সামার’ নামে পরিচিত ছিলেন।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল এবং চারুকলা অনুষদের সামনের রাস্তায় ভাসমান দোকান থেকে চাঁদাবাজি, হলের গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের মানসিক নির্যাতন এবং টর্চার সেলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের মতো  তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

মামলা থেকে বাঁচতে ঢাবির রানিং ছাত্রের দাবি:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সির অভিযোগে আটক হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রানিং (বর্তমান) ছাত্র না হলেও মামলা থেকে বাঁচতে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ মাস্টার্সের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র না হলেও নিজেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদপ্রত্যাশী হিসেবে জাহির করতে হলের আবাসিক ছাত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এখলাছ ২০১৩-১৪ সেশনের ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে ভর্তি হন।  ২০১৯ সালে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। হলে কয়েক বছর "দ্বৈতাবাসিক ছাত্র" ছিলেন । কখনো আবাসিক ছাত্র ছিলেন না।

তথ্য দিতে ঢাবি প্রশাসনের গড়িমসি:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখলাছুর রহমানের একাডেমিক তথ্য নানা টালবাহানা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের জনৈক কর্মকর্তা তথ্য দিতে গড়িমসি করলে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ডঃ মোঃ মাসুদুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি শুধু ভর্তির সেশন এবং আবাসিক ছাত্র কিনা এতটুকু তথ্য দিতে রাজি হন। কতবার পুনঃ ভর্তি হয়েছেন, কী কারণ দেখিয়েছেন, অনার্স এবং মাস্টার্স পাসের সন সহ কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে রাজি হয় নি হল প্রশাসন। একই অবস্থা তার সঙ্গীত বিভাগের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ সঙ্গীত বিভাগের অফিসে জানান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিভাগ থেকে তার বিরুদ্ধে তথ্য দিতে নিষেধ করা হয়।

তবে সঙ্গীত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখলাছ ২০১৫-১৬ সেশনে পুনঃ ভর্তি হয়ে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরু। তবে তার ভর্তির সেশন জানাতে রাজি হয় নি সঙ্গীত বিভাগ। তবে জানানো হয়, তিনি ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ থেকে অনার্স পাস করেন।২০২০ সালে একই বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে একাডেমিক তথ্য নিতে গেলে "উপরের চাপ আছে " বলে জানান জনৈক এক কর্মকর্তা।

তবে গোপন সূত্রে জানা যায়, তিনি অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেছেন। বিভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে  প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তার ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যায় ‌‌‌‌‌২০২০ সালে। কিন্তু ছাত্রত্ব শেষ হলেও করোনা মহামারীর কারণে হল বন্ধ  থাকার পর ২০২১ সালের  অক্টোবরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের একটি রুমে অবৈধভাবে  থাকতেন।

টর্চার সেলে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ: 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র না হলেও হলের "রাজনৈতিক সিঙ্গেল রুম" এ থাকতেন তিনি। ছাত্রলীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি হলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এখলাছ। উত্তর বঙ্গের সন্তান হওয়ার সুবাদে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর "বিভাগ নিশ্চিত"  হওয়ার আগেই হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ  কর্মী এবং পরবর্তীতে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানীর আশীর্বাদ নিয়ে হল জীবনের শুরু থেকেই তৎকালীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাকসুদ রানা মিঠুর গ্রুপে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৭ সালে ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সরকার জহিরুল ইসলাম রায়হান-মেহেদী হাসান সানীর কমিটিতে যুগ্ন সাধারন সম্পাদক ছিলেন। হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানীর অনুসারী হিসেবে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ ব্যবহার করে হলের‌ খাবারের ডাইনিং এ  ফাও খেতেন। হলের কোন দোকান থেকে জিনিস পত্র কিনলে ‍‍`পরে দিচ্ছি‍‍` বলে কয়েক দিন হারিয়ে যেতেন। পরে আর টাকা পরিশোধ করতেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানীর ডানহাত হিসেবে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান গ্রুপের কর্মী পরিচয় দিতেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নবগঠিত হল কমিটির সভাপতি এবং হলের সাবেক ভিপি

শহিদুল হক শিশিরের অনুসারী হিসেবে রাজনীতির গ্রুপ বদল করে এখলাছ। হলের রাজনৈতিক গুরু সানীর "ম্যাশলম্যান" হিসেবে পরিচিত ছিলেন এখলাছ। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র না হলেও তার বিরুদ্ধে হলের গেস্ট রুমে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক নির্যাতন এবং টর্চার সেলে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের মতো গুরুতর অভিযোগ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু গুরু সানীর ভয়ে ভীত হয়ে কেউ মুখ খুলতে পারত না। চারুকলা অনুষদের একটি বিভাগের ছাত্র ছিলেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী। তাই সানীর আশীর্বাদ নিয়ে চারুকলা অনুষদের সামনের রাস্তায় ভাসমান দোকান গুলো থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন।

এখলাছের  গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার শালাইপুর ইউনিয়নের কয়াতপুরে।
তার বাবা আবুল কাশেম জানান, আমি একজন কৃষক। কষ্ট করে ছেলে কে পড়ানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু আজ‌ আমার ছেলের অপকর্মের জন্য গ্রামের লোকজন কে মুখ দেখাতে পারছি না।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,গত হলের কাউন্সিলে ছাত্রলীগের সভাপতি পদ প্রত্যাশী ছিল‌ এখলাছ। কিন্তু পদ না পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করতেন তিনি। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং হলের লাইব্রেরীতে মাঝে মাঝে পড়তে যেতেন।

লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন না এখলাছ:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে ২০১৩-১৪ সেশনের ছাত্র হলেও দুই বছর ইয়ার লস্ট দিয়ে ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র হিসেবে ক্লাস শুরু। তবে তিনি লেখাপড়ায় খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না। মাদকাসক্ত চেহারা নিয়ে মাঝে মাঝে ক্লাস করতেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মেয়েদের কে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের এক কর্মকর্তা জানান,"২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ থেকে অনার্স পাস করে চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে সাময়িক সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলেও ২০১৯ সালে অনার্স পাসের সনদ এবং ২০২০ সালে সে মাস্টার্স পাসের সনদ সংগ্রহ করেননি এখলাছ।

এখলাছের বিষয়ে  ছাত্রলীগের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখার সাবেক এবং বর্তমান সভাপতি এবং সাধারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তারা সাড়া দেন নাই।

কেএস 

Link copied!