Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

চা-শ্রমিকদের জীবনের দুষ্টচক্র ভাঙা সময়ের দাবি

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

আগস্ট ১৯, ২০২২, ০২:০২ এএম


চা-শ্রমিকদের জীবনের দুষ্টচক্র ভাঙা সময়ের দাবি

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারা দেশের ২৩১টি চা-বাগানে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছেন চা-শ্রমিকরা। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন জেলার চা-বাগানগুলোর শ্রমিকরা। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এ টাকা অত্যন্ত অপ্রতুল।

তাই মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে ৯ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত তারা দৈনিক দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন। আর সরকার দলীয় এমপি উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুশ শহীদ জাতীয় সংসদে চা-শ্রমিকদের জন্য ৫০০ টাকা মজুরির পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের ১০ জন শ্রমিক নেতার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসলেও আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। তাই গত ১৩ আগস্ট থেকে টানা ধর্মঘটের ডাক দেন শ্রমিকরা।

চা-বাগান সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, চুনারুঘাট, মাধবপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার ৭০৩.২৪ হেক্টর জমিতে ২৫টি ফ্যাক্টরিযুক্ত চা-বাগান রয়েছে। এ ছাড়া ফাঁড়িসহ প্রায় ৪১টি বাগানের প্রায় প্রতি হেক্টর জমিতে ২২-২৫ শ কেজি চা-পাতা উৎপাদন হয়। এসব বাগানে বছরে এক কোটি ৩০ লাখ কেজি চা-উৎপাদন হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ চা-বোর্ড ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সব মিলিয়ে ২৫৬টি চা-বাগান আছে। এতে নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ তিন হাজারের উপরে। অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ হাজার। দেশে মোট চা-শ্রমিক পরিবারের বাসিন্দা প্রায় আট লাখ। এর মধ্যে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার। বাগানে কাজ না পেয়ে হাজার হাজার শ্রমিক বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

চা-শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা জানান, প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। অথচ, বাংলাদেশের চা-শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা-সংসদ নেতাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এসময় শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চুক্তির ১৯ মাস অতিবাহিত হলেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেনি মালিকপক্ষ। তাই তারা আন্দোলনে নেমেছেন।

হবিগঞ্জের চান্দপুর বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সাধন সাঁওতাল বলেন, বাংলাদেশে চা-শ্রমিকদের একটি বিশাল অংশ রয়েছে। এ দেশের ভোটার হয়েও আমরা অবহেলিত। মৌলিক অধিকারও আমাদের ভাগ্যে জোটে না। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ১২০ টাকা মজুরি পাই।

এভাবে আর আমরা চলতে পারছি না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। চা-বাগান, পাহাড়ের ঢালে সাজানো সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় আমাদের। এই বাগানের পাতা থেকে তৈরি চা আমাদের ক্লান্তি দূর করে, মনে প্রশান্তি দেয়। নানা জরিপের তথ্যে চোখ বুলিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দশম বৃহৎ চা-উৎপাদনকারী দেশ আর রপ্তানিতে নবম।

ইংরেজ আমলে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল পাহাড়ি টিলা আর ঢাল পরিষ্কার করে চা-বাগানের সূত্রপাত করেছিল। বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মানুষেরা চা-শ্রমিকের কাজটিই করে যাচ্ছে।

মোট চা-শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী এবং তাদের প্রায় সবাই খুব ছোটবেলা থেকেই চা-বাগানে কাজ করা শুরু করেছে। প্রতিটি চা-শ্রমিককে দিনে ২৩ কেজি চা-পাতা তোলার টার্গেট দিয়ে দেয়া হয়। বাগান বিশেষে হয়তো এই টার্গেটটি ১৮ থেকে ২৪ কেজিতে উঠানামা করে।

তবে এই টার্গেট দিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি সিলেটের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য চা-বাগানেও আছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে কাটা যায় মজুরি। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে যেমন মজুরি কাটা যায় তেমনি টার্গেটের চেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারলে প্রতি কেজি পাতার জন্য দুই থেকে তিন টাকা বাড়তি মজুরি দেয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টার্গেট অর্জনে চা-শ্রমিকরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য নেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের শিশু সদস্যদের যুক্ত করা হয়।

যে বয়সে শিশুটির সময় কাটানোর কথা ছিল স্কুলের প্রাঙ্গণে সমবয়সিদের সাথে খেলাধুলা করে সেখানে দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ির খোঁজ করতেই অস্ত যায় সোনালি সূর্য। তবে, খোলা চোখে চা-বাগানে শিশুশ্রমের ব্যাপারটি সেই অর্থে দৃশ্যমান নয়। পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে কাজ করতে করতে চা-বাগানের কাজে জড়িয়ে যায় তারা। তবে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগে নিবন্ধিত করা হয় না তাদের। ফলে মালিকপক্ষের কাঁধে শিশুশ্রমের দায় চাপানো যায় না। পরিবারের সদস্যরা কয়েক টাকা বাড়তি মজুরির আশায় নিজেরাই তাদের সন্তানদের কাজে নিয়োজিত করে থাকেন।

চা-বাগানের চৌহদ্দিতে মাঝে মধ্যেই দেখা মিলে স্কুলের। ইউনিসেফ কিংবা অন্য কোনো দাতব্য সংস্থার স্কুলের রঙিন দালানগুলো দূর থেকে ডাকতে থাকে শিশুদের। চা-শ্রমিকদের অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানরা চা-বাগানের বাইরে পা রাখবে। কিন্তু সেই আশা অনেক সময় ধোঁয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। প্রাথমিক কিংবা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও চা-বাগান এলাকা থেকে বহুদূরের উচ্চ বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠানোর সাহস করেন না অনেকেই।

মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতে আছে ভাষার সমস্যাও। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল বলছে— চা-বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে ১০টিরও বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। চা-বাগানের শ্রমিকদের যেহেতু আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহারের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মাতৃভাষা ছিল আলাদা।

উড়িষ্যা থেকে আসা চা-শ্রমিকের বংশধররা কথা বলেন ‘দেশালি’ ভাষায়, যেটি বাংলা আর ওড়িয়া ভাষার একটি মিশ্রিত রূপ। প্রচলিত আছে ভোজপুরি, হিন্দি, অসমীয়া, মুণ্ডা, ওরাং, তেলেগু, খাসি আর সাঁওতালি ভাষাও। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট প্রান্তিক এই মানুষগুলোর কাছে মাতৃভাষা চর্চা আর নিজেদের ভাষায় লেখাপড়ার দাবিটাও ঝাপসা হয়ে আছে।

চা-গাছ রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা আর চা-পাতা সংগ্রহের প্রধান কাজটি নারী শ্রমিকরা করে আসছে বংশানুক্রমে। নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেক যত্নের সাথে এই কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকদের একটি বড় অংশই কাজ করে চা-পাতা প্রক্রিয়াজাত করার কারখানায়, নিরাপত্তাকর্মী, চা-পাতা পরিবহন, ওজনকারী, বাগানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কিংবা শ্রমিকদলের সর্দার হিসেবে। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই বিশাল অংশের কি চা-বাগানে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই?

এই প্রশ্নের মূল উত্তর লুকিয়ে আছে চা-শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থার সাথে। ১৮৫৪ সাল থেকেই যখন চা-শ্রমিকদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয় তখনই তাদের আবাসনের দায়িত্ব নিয়েছিল চা-বাগানের মালিক পক্ষ। চা-বাগানে কাজ করে এমন যে কারো আবাসন চা-বাগান কর্তৃপক্ষই করে দেবে। চা-বাগানে কাজ করে না এমন কেউ চা-বাগানে বসবাস করতে পারবে না।

ফলে চা-বাগানের আবাসন বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি পরিবারের অন্তত একজনকে চা-শ্রমিক হিসেবে বংশানুক্রমে কাজ করেই যেতে হবে। স্বল্প মজুরিতে ক্রমবর্ধমান পরিবারের চাহিদা মেটাতে একই পরিবার থেকে অনেকেই চা-বাগানে কাজ নিতে শুরু করে। পরিবার আলাদা হয়ে গেলে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের নতুন আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়।

এই স্বল্প মজুরিতে যেখানে তাদের জীবন ধারণই কঠিন সেখানে তাদের কেউ টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনে মূলধারার সমাজে বসবাস শুরু করবে এই চিন্তাটিও করা কঠিন। ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তর ফারাকের কারণে মূলধারার বাঙালি সমাজের কাছেও নিগ্রহের শিকার এই চা-শ্রমিকরা। চা-বাগানের শিশুরাও প্রাক প্রাথমিক আর প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরোতেই ডাক পড়ে চা-বাগানে কাজ করার।

পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কেউ চা-শ্রমিকের পদ থেকে অবসর নিলে সেই পরিবারের কাউকে চা-শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের অগ্রাধিকার দেয়া হয়, যাতে তার পরিবারের আবাসনটি টিকিয়ে রাখা যায়। চা-বাগানে শ্রমিক বিদ্রোহও হয়েছে অনেকবার।

তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহটি হয়েছিল ১৯২১ সালের ২০ মে। বৃহত্তর সিলেট এলাকার চা-বাগানের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ এই নামে আন্দোলনের ডাক দেয়। নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে তারা চা-বাগান থেকে বেরিয়ে দলে দলে রওনা হয় চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের দিকে। তবে সেখানে চলে পুলিশের গুলি, মারা যায় অনেকেই। বাকিরা জীবনের ভয়ে পালিয়ে আবারো চা-বাগানে আশ্রয় নেয়।  

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন শুধু দরিদ্র এবং পশ্চাৎপদই নয়। বিভিন্ন ভাষা, জাতি-পরিচয়, ধর্ম, সংস্কৃতি ও একটি বিশেষ পেশা অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষ এরা। এরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও পেছনে পড়ে আছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সমান সুযোগ-সুবিধাই যথেষ্ট নয়; দরকার আরো বেশি কিছু। কাজেই চা শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার করতে হলে প্রথমেই শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা তাকে যেসব অধিকার দেয়, সেসব নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র তাদের জন্য যে বরাদ্দ রেখেছে, তা আরো বাড়াতে হবে। ভূমির মালিকানা বঞ্চিত চা বাগানে ‘বাঁধা’ পড়া এসব মানুষের জন্য আরো অনেক কিছু করার আছে তাদের নিয়োগদাতা, রাষ্ট্র এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং বৈচিত্র্যময় জাতি-পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সেসব ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক সুরক্ষাই পেছনে পড়ে থাকা চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজনকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে। এমনিতেই চা-শিল্প বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের এমন ধর্মঘটে এই শিল্প খাত আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাগানে নতুন পাতা গজিয়েছে।

পাতাগুলো এখনই তোলা না হলে সেগুলো মান হারাবে। এ জন্য বিষয়টি এখনই সমাধান প্রয়োজন।সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত চা-শ্রমিকদের দাবি পূরণ করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জয় হোক মেহনতি চা-শ্রমিকদের আন্দোলন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

Link copied!