ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Amar Sangbad

ইনস্টাগ্রাম

Amar Sangbad

এক্স

Amar Sangbad


লিংকডইন

Amar Sangbad

পিন্টারেস্ট

Amar Sangbad

গুগল নিউজ

Amar Sangbad


হোয়াটস অ্যাপ

Amar Sangbad

টেলিগ্রাম

Amar Sangbad

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Amar Sangbad


ফিড

Amar Sangbad

ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই, ২০২৫
Amar Sangbad

৫২ থেকে ৭১: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ

প্রফেসর ড. আসাবুল হক

প্রফেসর ড. আসাবুল হক

মার্চ ২২, ২০২৩, ০৬:৪৬ পিএম

৫২ থেকে ৭১: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ

৫২ যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি ৭১ আমাদের পরিচয়। ৫২ যেমন দিয়েছে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার, তেমন ৭১ দিয়েছে পৃথিবীর বুকে একখন্ড মানচিত্র। এই অধিকারগুলো যাঁরা বুকের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছেন তাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি, জানাতে পারি অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

একবার এক বন্ধু আমাকে জিঙ্গেস করেছিল, গত ১০০ বছরে সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য ঘটনা কোনটি? আমি বলেছিলাম, ‘চাঁদে মানুষ যাওয়া।’ সে একমত না হয়ে বলেছিল, ’মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য রাজপথে রক্ত দেওয়া।’ আমি তার সাথে একমত না হয়ে পারিনি। কারণ পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালি জাতিকেই মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে, রাজপথে রক্ত দিতে হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে এবং বাংলা ভাষায় কথা বলা বন্ধ করতে সবরকম চক্রান্ত করেছিল।

তবে এ চক্রান্ত রুখে দিয়েছিল আমাদেরই সোনার ছেলেরা, গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন। আর এ আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছিল ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে, ৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার চত্বরে। অনেকের মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জোহার আত্মত্যাগই বেগবান করেছিল ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ৭১-এর স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ভূমিকা ছিল আরও গৌরবের। গর্বে বুকটা আরও ভরে যায় যখন দেখি এ বিভাগেরই দু’জন শিক্ষককে ৭১-এ অসামন্য অবদানের জন্য জাতি তাঁদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে। তাঁরা হলেন, প্রফেসর হবিবুর রহমান (একুশে পদকধারী, ১৯৮৪) এবং মজিবুর রহমান দেবদাস (একুশে পদকধারী, ২০১৫)। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সন্দেহ ভাজনরা সকলেই একে একে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকেন।

তবে প্রফেসর হবিবুর রহমান সাহেব পালালেন না। দেশজুড়ে হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে বাসায় কালো পতাকা উড়িয়ে দিলে পাক সেনারা পতাকা নামিয়ে নেয়। ক্যাম্পাসের খালি বাসায় সেনারা লুটতরাজ শুরু করলে হবিবুর রহমান তাদের সরাসরি বাধা দেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থেকেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংঙ্গে যোগাযোগ, বুদ্ধি পরামর্শ ও অর্থ সাহায্য করতে থাকেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যখন খুব খারাপ হয়ে পড়ে তখন অনেকেই প্রফেসর হবিবুর রহমানকে অনুরোধ  করেছিলেন নিরাপদ স্থানে চলে যেতে। কিন্তু তিনি যান নি। তিনি তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাস ছাড়তে চাননি। অবশেষে ৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈনিকরা এসে তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফিরে আসেন নি।

গণিত বিভাগের আরেক মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস। অধ্যাপক মজিবর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যায়নকালে ভাষা অন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একটু খেয়ালী প্রকৃতির এবং চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি মনে-প্রাণে একজন অসম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিকট একটি চিঠি পাঠালে বিশ^বিদ্যালয় এই চিঠি সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ একজন ক্যাপ্টেন বললেন, ’আমার সাথে আসুন।’ উত্তরে অধ্যাপক বললেন, ’আমি রান্না করছি। আমাকে দুপুরের খাবার খেতে দাও।’

তাঁর সে ভাত আর খাওয়া হয়নি। পাক সেনাবাহিনী তাঁকেসহ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম ও অধ্যাপক অজিত রায়কে ধরে নিয়ে গিয়ে জানতে চায়, ’এখানে কোন হিন্দু শিক্ষক আছে কিনা?’ মৌনতাপস মজিবর রহমান নির্বিকার চিত্তে বলে দেন, ’এখানে কোন হিন্দু নাই।’ জীবন রক্ষার্থে অনেকেই যখন হিন্দু নাম বাদ দিয়ে মুসলিম নাম রাখা শুরু করেছিল তখন এর প্রতিবাদ ও ক্ষোভে আপন মুসলমানী নাম পরিত্যাগ করে তিনি ’দেবদাস’ নাম গ্রহণ করেন। অনেকেই একে পাগলের কান্ড কারখানা বলে অভিহিত করেন। কিন্তু অধ্যাপক রহমানের এ প্রতিবাদ ছিল তথাকথিত ‘মুসলমান’ পাক বাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অন্তরের জ্বালা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। এর পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়ে একবারও তিনি ভাবেন নি। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জানাজানি হলে মুসলিম বিশ্বে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বিধায় পাক সেনারা অধ্যাপক দেবদাসকে গ্রেপ্তার করে রাজশাহী ও নাটরে পাকিস্তানী সেনাক্যাম্পে মানুষিক ও শারীরিক অত্যাচার করে।

কখনো বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, কখনো লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে, কখনো বা চোখের দু’দিকে সূঁচ ফুটিয়ে রক্ত বের করে। এভাবে দীর্ঘ চারমাস ধরে রাজশাহী, পাবনা ও নাটোরের বিভিন্ন কন্সেট্রেশন ক্যাম্পে পাকিস্তানীদের ‘বেটার লাঞ্চ’ খেয়ে খেয়ে অধ্যাপক মজিবর রহমান যখন সাধারণ ক্ষমার প্রেক্ষিতে নাটোর ক্যাম্প থেকে ছাড়া পান তখন তিনি মৃতপ্রায়। নির্যাতনে অধ্যাপক মজিবর রহমান মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

পরে একটু সুস্থ ও স্বাভাবিক হলে ১৯৭৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক মজিবর রহমান আদালতে এফিডেভিটের মাধ্যমে ঘোষণা করেন, আজ থেকে আমার নাম হবে ’দেবদাস’। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন, তাঁকে যেন দেবদাস নামে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫২তম সিন্ডিকেট সভায় তাঁর নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব অনুমোদনও পায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে কোনো চিঠি না দিয়ে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে। মৃতপ্রায় ও বিকৃত মস্তিস্ক অধ্যাপক দেবদাস ১৯৭১ সালে ৫ সেপ্টম্বর ছাড়া পেয়ে জয়পুরহাটে নিজ বাসভবনে ’জীবন্ত শহীদ’ হয়ে বেঁচে থাকেন। তবে তাঁকে প্রতিদিন সকালে জাতীয় এবং আঞ্চলিক পত্রিকা পড়ার জন্য দিতে হয়। স্বাধীনতার পর কেউ অধ্যাপক দেবদাসের খবর রাখেননি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৮ সালের ২ আগষ্ট অধ্যাপক মজিবরকে সংবর্ধনা দেয়।

‘জীবন্ত শহীদ’ এই অধ্যাপককে জনসমক্ষে তুলে ধরেন নাজিম মাহমুদ তাঁর ‘যখন ক্রীতদাস স্মৃতি: একাত্তর” গ্রন্থে। কালের সাক্ষী ইতিহাসের বুকে চির অমর হয়ে রইলেন অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস। অধ্যাপক দেবদাস যেভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন, এই বাংলাদেশে তার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। দেরিতে হলেও ২০১৫ সালে সাহসী এ শিক্ষককে সরকার ২১শে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন। এ খবরে পরিবার ও গ্রামবাসী আনন্দিত হলেও স্মৃতি হারানো অধ্যাপক মজিবর কিছুই বুঝতে পারেননি। অধ্যাপক দেবদাস ২০২০ সালের ১৮ই মে পরলোকগমণ করেন।

স্বাধীনতার নির্ভিক সৈনিক অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস-এর জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ আজ যেমন গর্বিত, তেমনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: প্রক্টর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
 

Link copied!