নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই ১৫, ২০২৫, ১২:২৩ এএম
যতদিন এসব রিকশা চলবে, ততদিন ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা বাড়তেই থাকবে— অধ্যাপক শামছুল হক পরিবহন ও নগরবিদ
নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো এখন আবার নতুন করে দাবি তোলা হচ্ছে— রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন
নিয়ন্ত্রণ বা অনুমোদনের দায়িত্ব বিআরটিএর নয় তবে বন্ধ করাই উচিত: বিআরটিএ
রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ এক আগ্রাসনের নাম এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা। একসময় গ্রামীণ জনপদে সীমাবদ্ধ থাকা এ বাহন আজ ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক, এমনকি বিমানবন্দর সড়ক ও উড়ালপথেও অবাধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ এই যান নিষিদ্ধ, অননুমোদিত, নিবন্ধনবিহীন। তবু নিয়ন্ত্রণের কোনো ছাপ নেই।
ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা এমনিতেই সংকটাপন্ন। তার ওপর ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন যেন বিষফোঁড়া। সর্বশেষ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীর সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ শতাংশ ঘটনার পেছনে এই যানই দায়ী। অথচ সরকারের কোনো দপ্তরের কাছেই নেই কত সংখ্যক ব্যাটারি রিকশা চলছে, তার কোনো পরিসংখ্যান। সংশ্লিষ্ট সূত্র ও ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞদের হিসাবে, ঢাকায় এখন ১০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে; সবই অননুমোদিতভাবে। এমনকি অনুমোদিত প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়েও সংখ্যায় বহুগুণ বেশি।
সরকারি অনুমোদন না থাকলেও, ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল রীতিমতো একটি সংঘবদ্ধ ‘সিন্ডিকেটের’ নিয়ন্ত্রণে। এলাকাভেদে প্রতিটি রিকশার জন্য মাসিক এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। এ চাঁদা আদায়ের সুবিধার্থে চালু করা হয়েছে কার্ড সিস্টেম। যেখানে প্রতীক অনুযায়ী রিকশা কোথায় চলবে, কার অধীনে চলবে, সেটি নির্ধারিত। এই অবৈধ চাঁদা সংগ্রহের টাকা ভাগ হয়ে যায় স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার পকেটে, যায় পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য ও শ্রমিক সংগঠনের নেতার হাতেও।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় যখন রাজধানী প্রায় ‘শাটডাউন’ হয়ে যায়, তখনই রাস্তায় ‘বিকল্প’ বাহন হিসেবে বেড়ে যায় ব্যাটারি রিকশার চলাচল। এরপর থেকেই মূলত রাজধানীর সর্বত্র এই বাহনের ‘আধিপত্য’ বিস্তার ঘটে। গত বছরের ১৫ মে বিআরটিএ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ঘোষণা দেয়া হয় রাজধানীতে এসব যান চলবে না। কিন্তু বাস্তবে তার বাস্তবায়ন হয়নি।
এমনকি সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ, পুলিশ বা আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না— এই রিকশাগুলো চলবে কি না, চললে কে অনুমতি দেবে! বাংলাদেশে বৈধ যান্ত্রিক যানবাহনের অনুমতি দেয় বিআরটিএ। ছোট যানবাহনের অনুমোদনের দায়িত্ব থাকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আরটিসির ওপর। ঢাকা সিটির অধীনে প্রথাগতভাবে প্যাডেল রিকশা অনুমোদিত, ব্যাটারি রিকশা নয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশেও এই বাহনের চলাচল নিষিদ্ধ। তবু প্রশ্ন উঠে, এই নিষিদ্ধ যান প্রতিদিন কীভাবে চলছে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংগঠনিক মৌন সম্মতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমেই এসব নিষিদ্ধ চলছে।
পুরান ঢাকা, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর অন্তত ১০টি এলাকায় গড়ে উঠেছে শত শত গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, যেখানে ব্যাটারি রিকশা তৈরি বা প্যাডেল রিকশা রূপান্তর করা হচ্ছে। এখানে ব্যবহূত হচ্ছে কম মানের ব্যাটারি ও ইলেকট্রিক মোটর, যার সুরক্ষা বা রোড রেজিস্ট্রেশন নেই। চার্জিংয়ের জন্য প্রতিটি ব্যাটারির জন্য দৈনিক ৩৫ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত গ্যারেজ ফি আদায় করা হয়।
যদিও বর্তমানে ইলেকট্রিক ভেহিকেল (ইভি) নীতিমালা তৈরি হয়েছে, সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার মতো তিন চাকার যান অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে নতুন করে আলাদা নীতিমালা তৈরির কথা বলা হচ্ছে। এই নীতিমালায় চালকের লাইসেন্স, গতিসীমা, চার্জিং স্টেশন, রুট পারমিট ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তবে তার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা নিয়েই সংশয়।
পরিবহন ও নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, আইন ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। একটি বৈধ কাঠামোর বাইরে যতদিন এসব রিকশা চলবে, ততদিন ট্রাফিক অব্যবস্থা বাড়তেই থাকবে। রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা আরিফুল ইসলাম স্বীকার করেন, আগে চাঁদা নিয়মিত দিতে হতো, এখন কিছু এলাকায় নতুন করে আবার দাবি তোলা হচ্ছে।
বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, এই যান নিয়ন্ত্রণ বা অনুমোদনের দায়িত্ব বিআরটিএর নয়। তবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে এমন যান বন্ধ করাই উচিত।