নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই ১৬, ২০২৫, ১২:১১ এএম
ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পেতে দেশে বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন সাত লাখেরও বেশি চালক। সরকার ঘোষিত ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার আওতায় স্মার্ট কার্ড চালুর পর এই লাইসেন্স জট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাইসেন্স পেতে বিআরটিএর সব প্রক্রিয়া শেষ করার পরও তারা কেবল অপেক্ষাই করছেন বছরের পর বছর। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো, এসব ভুক্তভোগী চালক পুলিশেরও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পুলিশ অনেক সময় ই-লাইসেন্স মেনে নিচ্ছে না। চালকদের কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হয়, যা বিআরটিএ নিজেই সময়মতো দিতে পারছে না। এমন বাস্তবতায় চালকরা পড়েছেন এক ভয়াবহ প্রশাসনিক দুষ্টচক্রে।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, বর্তমানে প্রায় সাত লাখ তিন হাজার চালক বিআরটিএর লাইসেন্সের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা সবাই লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, কিন্তু স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়ায় কার্যত অর্ধ-আইনগত পরিস্থিতিতে আছেন। এই অবস্থায় তাদের কেউ কেউ ট্রাফিক পুলিশের মামলায় পড়ছেন, কেউ আবার মোবাইল কোর্টে ভ্রাম্যমাণ শাস্তির মুখে পড়ছেন। চালকদের অভিযোগ, বিআরটিএ বলছে তারা ই-লাইসেন্স দিচ্ছে, কিন্তু পুলিশ সেটি মানে না। অনেকে বলেন, মোবাইলে ই-লাইসেন্স দেখালেও পুলিশ বলে, কাগজ লাগবে। ব্যাস, মামলা ঠুকে দেয়। আমরা যাব কোথায়?
বিআরটিএ ২০২০ সালে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য ৪০ লাখ স্মার্ট ড্রাইভিং কার্ড সরবরাহের চুক্তি করে, যার আর্থিক পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হতে চললেও প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত সরবরাহ করতে পেরেছে মাত্র ২৮ লাখ কার্ড। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম তিন বছরে ২৪ লাখ এবং শেষ দুই বছরে আরও ১৬ লাখ কার্ড সরবরাহের কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা হয়নি। অথচ বর্তমানে সাত লাখের বেশি নতুন আবেদন ঝুলে আছে।
বিআরটিএ বলছে, কার্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কার্ড পাঠাচ্ছে, যার ফলে তা প্রিন্ট করার অনুমোদন দিচ্ছে না সংস্থাটি। অন্যদিকে ওই প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, তারা সর্বশেষ ভারত থেকে সাড়ে তিন লাখ কার্ড এনেছে, কিন্তু বিআরটিএ ইচ্ছে করেই প্রিন্টে দিচ্ছে না। চুক্তির শুরুর দিকে করোনা মহামারিতে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যাহত হয়। এরপর ২০২৩-২৪ সালে দেশে ডলার সংকট শুরু হলে এলসি (ঋণপত্র) খোলা সম্ভব হয়নি, ফলে স্মার্ট কার্ড আমদানি থমকে যায়। একপর্যায়ে কার্ড সরবরাহ এতটাই ব্যাহত হয় যে, বিআরটিএ গত মার্চ থেকে স্মার্ট কার্ড বিতরণ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। যদিও বিদেশগামী বা ইমারজেন্সি রোগীদের জন্য সীমিত ভিত্তিতে কিছু কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে— টিকিট, ভিসা বা মেডিকেল কাগজ দেখিয়ে।
বিআরটিএ দাবি করছে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত কেউ চাইলে তাদের কাছে একটি ই-লাইসেন্স বা অস্থায়ী অনুমোদনপত্র দেয়া হয়, যা দিয়ে বৈধভাবে গাড়ি চালানো যায়। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ সেই কাগজ মানতে চায় না। ফলে আইনগতভাবে বৈধ একজন চালককেও ‘অবৈধ’ বলে ধরে মামলা করা হয়। বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে ই-লাইসেন্স ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। পুলিশ কেউ হয়রানি করলে আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলি। তবুও মাঠে সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, সরকার নতুনভাবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ) লাইসেন্স ছাপার দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে। এতে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে বিএমটিএফ নতুন করে স্মার্ট কার্ড প্রিন্ট করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে। তবে চালকরা বলছেন, প্রতিশ্রুতি আমরা অনেকবার শুনেছি। কাজের কাজ কিছু হয় না। দুই-তিন মাস বললেও সেটা দুই বছরেও হয় না।