নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ৫, ২০২৫, ১২:০৮ এএম
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট— বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী দিন। এ দিনটিতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের অবসান হয়।
প্রায় দেড় দশকের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটায় ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের জেরে দেশের মানুষ যেমন দীর্ঘ শোষণের শৃঙ্খল ভাঙার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছে, তেমনি সেই দিনটি হয়ে উঠেছে ত্যাগ ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে। কারণ এদিন রক্ত দিয়েই মানুষ তাদের স্বাধীন মত, ভোট, সমতা ও ন্যায়ের অধিকার ফিরিয়ে এনেছে।
কোটা সংস্কার থেকে স্বৈরশাসনের পতন
২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্ট এক রায়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করে। শিক্ষার্থীরা এই রায় প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে নামে। ২০১৮ সালের মতোই তাদের দাবি ছিল— যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ, মেধার মর্যাদা এবং বৈষম্যের অবসান। কিন্তু সরকার আন্দোলন দমন করতে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেয়। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডার এবং পুলিশ যৌথভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। জুলাইজুড়ে রক্তাক্ত হতে থাকে রাজপথ।
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ : বিক্ষোভে আগুন ছড়ায়
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ২২ জুলাই শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না।’ কিন্তু সেই কথার দুই সপ্তাহের মাথায় ৫ আগস্টে তাকে পালাতে হয়। ৩ ও ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের ‘শক্তি প্রদর্শনের’ নামে সারা দেশে চালানো গণহত্যায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান।
পরিস্থিতির অবনতি দেখে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা সময় এগিয়ে এনে এক দফার ঘোষণা দেন— ‘৫ আগস্টই শেখ হাসিনার পতনের দিন’। তারা দিনটিকে অভিহিত করেন ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে, অর্থাৎ ‘জুলাই শেষ হবে না, শেখ হাসিনার পতন ছাড়া।’
৫ আগস্ট : ইতিহাসের মোড় ঘোরানো দিন
ভোর থেকেই রাজধানীর প্রবেশমুখে জড়ো হতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের গুলিবর্ষণ, কারফিউ— সবকিছুকেই অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীরা ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকেন। যাত্রাবাড়ী, উত্তরা হয়ে শাহবাগ, রমনা, তোপখানা, গুলিস্তান, আগারগাঁও, ফার্মগেট— সব এলাকাই পরিণত হয় গণআন্দোলনের মিছিলে।
দুপুর নাগাদ ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর এবং বিকেল ৪টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নিশ্চিত করেন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকার আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয় ‘জয় বাংলা নয়, জয় জনতা’ স্লোগানে।
গণভবন দখল, স্বৈরাচার পতনের পর উল্লাস
বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে পড়ে। কেউ চেয়ারে বসে ছবি তোলে, কেউ পতাকা ওড়ায়। সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বহু সরকারি ভবন যেন গণউদ্বোধনে রূপ নেয়। এই ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা সারা দুনিয়ার নজর কাড়ে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ‘গণ-উত্থান’কে স্বাগত জানায় এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানায়।
পরিণতি : অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন আশা
আন্দোলনের তিন দিনের মাথায় (৮ আগস্ট) গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অন্তর্বর্তী সরকারই বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছে এবং একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে বিগত এক বছরে দেশে ফিরেছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ এবং সবচেয়ে বড়— নাগরিকের ওপর আস্থা।
অশ্রুর বিনিময়ে অর্জিত বিজয়
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন, আহত ২০ হাজারেরও বেশি। কারো বাবা নেই, কারো ভাই, কেউ হারিয়েছেন সন্তান। এই রক্ত আর অশ্রু মিশিয়ে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
আজ ৫ আগস্ট : শোক আর গৌরবের দিন
শুধু জয় নয়, এই দিনটি বয়ে আনে বুকচিরে যাওয়া অনেক কষ্টের স্মৃতি। নিহতদের প্রতি রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা, রক্তস্নাত রাজপথে মিলনমেলা, শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি— সব মিলিয়ে আজ দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে স্বৈরাচার পতনের প্রথম বার্ষিকী। তবে অতীতের রক্তাক্ত ইতিহাস ভুলে নয়— মনে রেখেই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ।