নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ৫, ২০২৫, ১২:১৭ এএম
হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারদিকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য উঁচু ভবন। যা বিমানবন্দরে বিমান চলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিয়ম অনুযায়ী ৫০০ ফুটের ওপর ভবন তোলা নিষিদ্ধ থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। বরং বিমানবন্দরের কাছে যেখানে সেখানে যত্রতত্রভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
এমনকি শাহজালালের ভেতরে বেবিচক সদর দপ্তর ও মার্কেট উঁচু হওয়ায় ফ্লাইট ওঠা-নামায় সমস্যা হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বিমান নিরাপত্তায় বিমানবন্দরের আশপাশে আর যেন উঁচু ভবন তৈরি হতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমনকি অনুমতি ছাড়া গড়ে ওঠা উঁচু ভবনগুলো সরানো নিয়েও সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। সে ক্ষেত্রে যারা অনুমতি না নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকার হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশে আবাসিকের পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য অবকাঠামোও গড়ে উঠেছে। এমনকি নিয়ম ভেঙে বিমানবন্দরটির সীমানা ঘেঁষে বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে।
বেবিচকের নিয়ম অনুযায়ী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সীমানা ও আশপাশ এলাকায় ৫০০ ফুটের বেশি উঁচু ভবন তৈরি করা যাবে না। কিন্তু বেশিরভাগ ভবনই আট থেকে দশতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা আছে। তাছাড়া বিমানবন্দরের ভেতর ও বাইরেও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। খোদ বেবিচক কার্যালয়টিও বহুতল ভবন। তার পাশেই একটি বিশাল শপিং মল। আরেকটি উঁচু ভবন সেখানে নির্মিত হচ্ছে।
এরই মধ্যে বেবিচক বিমানবন্দরের রানওয়ের আশপাশে সহস্রাধিক ‘অধিক উচ্চতার’ ভবন চিহ্নিত করেছে। আর অনুমোদনের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার ভবন নির্মাণ করায় সেগুলো ফ্লাইট ওঠানামায় ঝুঁকি তৈরি করেছে। অথচ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ যে স্থান দিয়ে করে তার চারপাশ খোলা থাকতে হয়।
কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরের চারদিকে বড় বড় ভবন তৈরি করায় বিমান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত হলেও তাতে প্রতিদিন শতাধিক বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। যা নাগরিক এবং বিমান যাত্রীদের জন্য একটি স্থায়ী ঝুঁকি তৈরি করছে। ৪৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল চুক্তি রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানের পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি এয়ারওয়েজ যাত্রীবাহী বিমান সার্ভিস ছাড়াও ১০-১২টি বিমান সংস্থা কার্গো বিমান ও হেলিকপ্টার সার্ভিস পরিচালনা করছে। সেখানে প্রতিদিন ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করে। বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারপাশে অন্তত সহস্রাধিক ভবন রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ বিমানগুলো অন্য রুট ব্যবহার করা প্রয়োজন। কারণ প্রশিক্ষণরত বিমানের চালানোর গতি অনেক বেশি থাকে। ঘণ্টায় প্রায় ৭০০-৮০০ কিলোমিটার বেগে। আর উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় বাণিজ্যিক ফ্লাইটের গতি থাকে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের মতো। যে কারণে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু নিয়মের মধ্যে থাকার কথা বললেও বেবিচকের বিরুদ্ধেই আইন না মানার অভিযোগ উঠেছে।
সংস্থাটির সদর দপ্তরে দুটি বেজমেন্টসহ ১১-তলা তৈরি করেছে। পাশাপাশি সংস্থাটির সদর দপ্তরের সঙ্গেই সেন্টার পয়েন্ট নামে একটি শপিং মল, সিনেমা হলের বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়। ওই ভবনটিও আটতলা। শাহজালালের অভ্যন্তরেই দুটি উঁচু ভবন থাকায় প্রশ্ন উঠেছে।
তাছাড়া উত্তরা ১, ৫ ও ১৫ নম্বর সেক্টর, দলিপাড়া, উলুদাহা, পাকুরিয়া ও খিলক্ষেতসহ আরও কিছু এলাকায় উঁচু ভবন রয়েছে, সেগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওসব এলাকা দিয়ে বিমান ওঠানামা করে। এমন এলাকায় বিমান চলাচলের সময় অল্প কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা বৈমানিকের ভুল সিদ্ধান্তে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিশেষ করে বিমান উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাহলে তা সরাসরি নিচের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) অ্যানেক্স-১৪ নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এমন এলাকা নির্বাচন করতে হবে, যা জনবসতি থেকে দূরে, শব্দদূষণ কম এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি হ্রাসে উপযোগী। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিজস্ব নীতিমালাতেও এ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে জনবহুল এলাকায় প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে বিপদের আশঙ্কা তৈরি করছে। তাছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও একাধিক নির্দেশনা রয়েছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা ঠিক হচ্ছে না। শাহজালাল যখন চালু হয় তখন চারপাশে তেমন জনবসতি ছিল না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিনিয়ত বিমান ওঠানামার ফলে ওই এলাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সেজন্যই বিমানবন্দর শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
কারণ বর্তমানে ঢাকার উত্তরার মতো আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলো শাহজালালের রানওয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পাশাপাশি মিরপুর, তেজগাঁও, বনানী, খিলক্ষেত, আশকোনা, টঙ্গী ওসব এলাকাও উড্ডয়ন পথের মধ্যে পড়ে। যে কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আইডিয়াল অবস্থান হওয়া উচিত জনবহুল এলাকা থেকে অনেক দূরে। শাহজালালের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে। ঢাকা যত বড় হয়েছে, বিমানবন্দর ঘিরে ততই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গড়ে উঠেছে। সরকারের উচিত বিমানবন্দর এলাকায় বসতি উঠতে না দেয়া।