এপ্রিল ২৫, ২০২২, ১১:০২ এএম
- চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে শিক্ষকের সাংবাদিকতা, নাগরপুরের এমপির নির্দেশে তদন্ত বানচাল
- সাংসদ-শিক্ষা কর্মকর্তা-ওসি ও ইউএনওর রোষানলে আজিজুল
- সংবাদ প্রকাশ করায় তদন্ত কর্মকর্তার মিথ্যা মামলা
- শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণলায়: অতিরিক্ত সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
- সম্ভবত স্থানীয় সাংবাদিকরা আমাকে মিসগাইড করেছে: পুলিশ সুপার
- ফরহাদ আলীকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলাম, কিন্তু এমপি সাহেব ফোন করে তদন্ত করতে বারণ করেছেন: উপজেলা শিক্ষা অফিসার
সরকারি চাকরিবিধি উপেক্ষা করেই সাংবাদিকতা পেশায় জড়ানো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করায় মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলায় কারান্তরীণ টাঙ্গাইলের সাংবাদিক আজিজুল হক বাবু। যে মামলায় বাবুকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে; সে মামলার বাদী খোদ অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে থাকা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফরহাদ আলী।
কর্তৃপক্ষের অগোচরে সাংবাদিকতা করা শিক্ষক রামকৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি জেনেও স্থানীয় সাংসদের নির্দেশে চুপসে যাওয়া নাগরপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা সাংসদ টিটুর পরামর্শেই সাংবাদিক বাবুকে মিথ্যা মামলায় কারান্তরীণ করেছেন বলে চাউর রয়েছে। শুধু তাই নয়, সাংবাদিক বাবুকে কারান্তরীণ করতে কাজ করেছে অভিযুক্ত রামকৃষ্ণ সাহাসহ সাংসদ টিটুর সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের
সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা সাংসদ টিটুর পরিকল্পনায় ফরহাদ আলী পরিকল্পিতভাবে বাবুর বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
আর সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা থানার ওসি সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। যিনি মামলা দায়েরের পরপরই বাবুকে গ্রেপ্তারে ওত পেতে ছিলেন এবং মামলা দায়েরের দিন গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজ বাড়ি থেকে বাবুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান। প্রাথমিক সত্যতা যাচাই না করেই মামলা গ্রহণ করা সিন্ডিকেটের অপর সদস্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াহেদুজ্জামানও একটি ভিডিও ফুটেজের কথা উল্লেখ করে মৌখিক তথ্য দেন পুলিশকে। সেই আলোকেই বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানা গেছে।
অথচ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাহাঙ্গীর বলছেন, মামলাটি শুধু ফরওয়ার্ডিং দিয়ে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এখনো বাদীর সাথে তার কথা হয়নি, সাক্ষীদের সাথেও কথা হয়নি। প্রাথমিক সত্যতাও পাননি তিনি। ইউএনওর কার্যালয়েও ভিডিও ফুটেজের জন্য গত শুক্রবার গিয়েছিলেন তিনি, তবে পাননি। যদিও ওই ফুটেজের তথ্য উল্লেখ করেই ইউএনও ওয়াহেদুজ্জামান বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাবুকে চাঁদাবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে এখন তিনি বলছেন, শব্দ শোনা যায় না এমন একটি ভিডিও ফুটেজ রয়েছে তার কাছে।
সেখানে চাঁদা চাওয়া হয়েছে কি-না তা তিনি জানেন না। আগেও চাঁদা দাবির ঘটনা ঘটেছে কি-না তাও জানা নেই তার। কারণ নিজের কর্তব্যকাজে অবহেলা কিংবা অর্থের বিনিময়ে প্রভাবিত হওয়া শিক্ষা কর্মকর্তা ফরহাদ আলী কখনো তাকে মৌখিক বা লিখিতভাবেও চাঁদা দাবির বিষয়টি অবহিত করেননি।
পুরো ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, সাংবাদিক আজিজুল হককে কারাগারে প্রেরণে সিন্ডিকেট গঠনের একমাত্র কারণ শিক্ষক কাম সাংবাদিক রামকৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে করা লিখিত অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অগোচরে সাংবাদিকতা করছেন রামকৃষ্ণ সাহা; বিষয়টি অভিযোগ আকারে সামনে আনাই সাংবাদিক বাবুর বিরুদ্ধে হওয়া মামলার মূল কারণ। রামকৃষ্ণ সাহা স্থানীয় সাংসদ টিটুর ফেভারে সাংবাদিকতা করতেন।
যে কারণে সাংসদের আঁতে ঘা লাগে। তাই সাংসদ টিটু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে ফোন করে অভিযোগ তদন্ত করতে বারণ করেন। এমনটা জানিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার আঞ্জুমান আরা বীথি। তিনি বলেন, ‘আমি ওনাকে (ফরহাদ আলী) দায়িত্ব দিয়েছিলাম তদন্ত করার জন্য। কিন্তু এমপি সাহেব ফোন করে এ বিষয়ে তদন্ত করতে না করেছিলেন।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদ্যালয় অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাংবাদিকতা করতে পারবেন না। অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসাররা বিষয়টি তদন্তের এখতিয়ার রাখে অবশ্যই। তদন্তসাপেক্ষে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়।’
সাংবাদিক আজিজুল হক বাবু নাগরপুর উপজেলার বাবনাপাড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নাগরপুর উপজেলা সাবেক কমান্ডার সুজায়েত হোসেনের ছেলে। একই উপজেলা সদরের দোয়াজানি এলাকার মৃত জয়দেব চন্দ্র সাহার ছেলে রামকৃষ্ণ সাহা রামা উপজেলার মোকনা ইউনিয়নের পংবাইজোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে দৈনিক আমাদের সময় ও স্থানীয় টিনিউজবিডি.কম পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন। ২০২১ সালে টাঙ্গাইল জেলা শিক্ষা অফিসে বিষয়টি উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ করেন বাবু। এরই প্রেক্ষিতে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে (১৯ এপ্রিল ২০২২, সকাল ১১টায়) তদন্তের দিন ধার্য করে অভিযুক্ত শিক্ষক রামকৃষ্ণ ও অভিযোগকারী সাংবাদিক বাবুকে চিঠি দেয়া হয়। অথচ নির্ধারিত সময়ে অভিযোগকারী বাবু উপস্থিত হলেও অভিযুক্ত শিক্ষক ও তদন্ত কর্মকর্তা ফরহাদ আলী উপস্থিত না হয়ে তদন্ত বানচালের চেষ্টা করে।
অথচ এর আগে চলতি মাসের ১০ এপ্রিল ফরহাদ আলী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষকে প্রমাণাদিসহ উপস্থিত থাকতে বলা হয়। যথাসময়ে বাদী উপস্থিত থাকলেও রহস্যজনক কারণে অভিযুক্ত শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন না। আর কার্যালয়েও ছিলেন না তদন্ত কর্মকর্তা ফরহাদ আলী। যে কারণে সাংসদ টিটুর পরামর্শ অনুযায়ীই সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফরহাদ আলী (২১ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার) কৌশলে সাংবাদিক বাবুকে তার নিজ কার্যালয়ে ডেকে নেয় এবং সে দিনই বাবুর বিরুদ্ধে শিক্ষা কর্মকর্তা ফরহাদ তার নঙ্গিনাবাড়ী এলাকায় নবনির্মিত ভবন নির্মাণে বাধা ও চাঁদা দাবির বিষয়ে নাগরপুর থানায় মামলা করেন। অভিযোগে যতটা না ক্ষিপ্ত ছিল সিন্ডিকেট, রামকৃষ্ণ ও ফরহাদ আলীর অনুপস্থিতির বিষয়টি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয় ওই সিন্ডিকেট।
জানা যায়, চিঠি ইস্যুর পর তদন্ত বানচালের জন্য সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন রামকৃষ্ণ, অনুপস্থিতির সংবাদ প্রকাশের পর ফের যোগাযোগ করায় আরও ক্ষিপ্ত হন সাংসদ, শিক্ষা কর্মকর্তাসহ গোটা সিন্ডিকেট।
জানতে চেয়ে সাংসদ আহসানুল হক টিটুকে গতকাল একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার মুঠোফোনে সাংবাদিক বাবুকে গ্রেপ্তার এবং রামকৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বারণ করার বিষয়ে আপনার বক্তব্য প্রয়োজন উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
সাংবাদিক বাবুর বাবা সাবেক কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজায়েত হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রামকৃষ্ণ সাহার অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ করে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে নাগরপুর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফরহাদ আলীকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্তের নির্ধারিত তারিখে অভিযুক্ত রামা ও তদন্তকারী কর্মকর্তা কেউ উপস্থিত না হয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে টাঙ্গাইলের স্থানীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করে বাবু। এতেই ওই চক্রটি ক্ষিপ্ত হয়ে মিথ্যা বানোয়াট মামলা দিয়ে আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করায়। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং ঘটনার সঠিক তদন্তের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
আমার সংবাদ থেকে যোগাযোগ করা হলে একাধিক প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি নাগরপুর থানার ওসি সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে তিনি বলেন, এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু করা হয়নি।
সাংবাদিক বাবুর বাবার সাথেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মামলা করেছেন। আর এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা শিক্ষা অফিসার সবাই অবগত আছেন। অনেকটা অস্পষ্টভাবে চাপে থাকার কথাও বলেছেন তিনি। শেষে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলেও জানান।
সার্বিক বিষয় জানিয়ে পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানান। তিনি বলেন, আমি অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছি, প্রেস ক্লাব ও লোকাল সাংবাদিক সহ সবার সাথেই কথা বলেছি।
একপর্যায়ে তিনি বলেন, লোকাল সাংবাদিকরা হয়তো আমাকে তথ্যগতভাবে মিস গাইড করেছে। তবে তিনি ঘটনার সঠিক তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন আমার সংবাদকে।
এছাড়া তিনি বলেছেন, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে সাংবাদিক বাবু আগেও কয়েকবার চাঁদা চেয়েছেন। তবে তিনি চাঁদা দেননি। সম্প্রতি সিঁড়িতে ভিডিও ফুটেজে যখন দেখেছি তারপর মামলা নিয়েছি।
ভিডিওটি শব্দবিহীন, কী কারণে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে তার কারণ কিন্তু স্পষ্ট নয়— এমনটা জানালে তিনি বলেন, যারা সংক্ষুব্ধ তাদের কথার ভিত্তিতে আমরা মামলা নিয়ে থাকি। সংক্ষুব্ধরা যেটা বলেছেন তার ভিত্তিতে মামলা নিয়েছি।
এছাড়া আমরা তদন্ত করব যে, কার উপস্থিতিতে চাঁদা চেয়েছেন এবং সাক্ষী-প্রমাণ পেলে চার্জশিট দেব। এটা তদন্ত শেষে বলব।