Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

সংঘাতে যাচ্ছে বিএনপি

আবদুর রহিম

ডিসেম্বর ১৩, ২০২২, ০১:২১ এএম


সংঘাতে যাচ্ছে বিএনপি
  • ডিসেম্বরের শেষে জামায়াতকে সাথে নিয়ে রাজপথে বড় কর্মসূচি
  • বিএনপির উপস্থিতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে 
  • দুই মির্জা ও শীর্ষ নেতাদের আটকের পরও সমাবেশ বাস্তবায়নে সফলতা 
  • যুগপৎ আন্দোলনে সব দল একমত বড় কর্মসূচির আশ্বাস মোশাররফের

মাঠে নামল ঘরবন্দি বিএনপি। বাস্তবায়ন করল ঢাকার সমাবেশ। প্রকাশ্যে মাঠে উজ্জীবিত নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেয়া হলো বড় কর্মসূচির ব্যাপারে। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি দাবি বাস্তবায়নে এবার নরম কর্মসূচির মধ্যে থাকবে না। যদি প্রয়োজন হয় সংঘাতের পথ বেছে নেবে। রাজপথে নেমে সরকারকে সরাতে বাধ্য করা হবে। জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দলও সামনের সারিতে থাকবে।

দেশের রাজনীতিতে চোখ রাখা ব্যক্তিরাও বলছেন, গুলিতে দলের সাত কর্মী নিহত, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। বিএনপি আর অতীতের মতো শান্ত নীতিতে থাকছে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে এবার বিএনপি রাজপথকেই টার্গেট করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। অতীতে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতির কিছুটা আভাস পেলেও এবার সেটির লক্ষণ নেই। তবে সংঘাতের দিকেই যেতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে কারাগারে রেখে সমাবেশ বাস্তবায়ন করে ফেলা নজিরবিহীন সফলতা বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। অতীতে খালেদা জিয়া আটকের পর বিএনপি ঠাণ্ডা হলেও এবার সেই রূপ নেই। বিএনপি গরম হাওয়ার মধ্যে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে।  উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে রাজপথ এখনো উত্তপ্ত করে রেখেছে। গত শনিবার ঢাকার গণসমাবেশ থেকে এসেছে নতুন কর্মসূচি। ১০ দফা সামনে রেখে আগামী ২৪ ডিসেম্বর জেলা ও মহানগরে গণমিছিল নিয়ে নবউদ্যমে রাস্তায় নামবেন নেতাকর্মীরা।

এবার আর বিএনপি একা নয়; পাশে পাচ্ছে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে। জামায়াতে ইসলামীসহ ৩৩ দলকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি। প্রায় দুই মাসব্যাপী দলটির বিভাগীয় গণসমাবেশে বাস্তবায়ন করে চাঙা হয়েছে দেশের রাজনীতিতে। নির্বাচনের আরও এক বছর বাকি থাকলেও সরকার ও বিরোধী পক্ষ এখন মুখোমুখি। শক্তি প্রদর্শনের এই মহড়ায় আগামী বছরজুড়েই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সরকারের নমনীয় মনোভাব কাজে লাগিয়ে বিএনপি গত জুলাই মাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে শুরু করেছে। জেলায় জেলায় সমাবেশ কর্মসূচি পালন শেষে একপর্যায়ে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে নিহত কর্মীদের জন্য সমাবেশ করে এখন অনেকটা উজ্জীবিত। দেশ-বিদেশের বড় শিরোনামে অবস্থান করছে। কূটনৈতিক মিশনে ভালো অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে।  দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, এবার আর সরকারকে ছাড় দেয়ার সময় নেই। সরকার পতন না করে তারা ঘরে ফিরবেন না। সিনিয়র নেতাদের এমন বক্তব্যে প্রাণ ফিরে পায় মাঠের নেতাকর্মীরা। মামলা-হামলার ভয় উপেক্ষা করে তারা সরব থেকেছেন রাজপথে। রক্ত ঝরিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তাদের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোবল উজ্জীবিত করেছে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। দলীয় সভা-সমাবেশে তাদের সরব উপস্থিতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন শিবিরেও। 

রাজনীতিতে চোখ রাখা ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির টানা কর্মসূচিতে দলটির নেতাকর্মীরা যেভাবে উজ্জীবিত হয়েছেন; তাতে তাৎক্ষণিক না হলেও দীর্ঘমেয়াদি ফল মিলবে যা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। গত কয়েক মাস ধরে অনেক কষ্ট করে রাজপথে থেকেছে। তারা কাঁধে কাঁধ রেখে একসঙ্গে সমবেত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, উজ্জীবিত হয়েছে— এটা কম প্রাপ্তি নয়। তবে আগামীতে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কৌশল সম্পর্কে সতর্ক হওয়া জরুরি।

সমাবেশ বাস্তবায়নে এগিয়ে গেল বিএনপি : গত শনিবার রাজধানীর গোলাপবাগে শান্তিপূর্ণভাবে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে উত্তেজনার পারদ আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে। মাসজুড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ হয়। সমাবেশের ভেন্যু নিয়ে ঘটে সংঘর্ষ। শীর্ষ নেতাসহ কয়েকশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একপর্যায়ে সমাবেশ হবে কি হবে না- এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লেও শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ছাড়াই সমাবেশ শেষ হয়। এই সমাবেশ থেকে একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির সাত সংসদ সদস্য। বিষয়টি সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চায় নতুন ইস্যু তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি এই সমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় দলটি। তবে এই সমাবেশ ঘিরে বিএনপির ভেতরে ও বাইরে চুল-চেরা বিশ্লেষণ চলছে।

যুগপৎ নিয়ে সব দলে একমত : ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগ, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তি, গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিসহ যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এই দফাগুলো নিয়ে সমমনা দলগুলোর মতামত ও সম্মতি নেয়া হয়েছে বলে সমাবেশের বক্তব্যে দাবি করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওইদিন রাতেই জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট ১০ দফার সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। এরপর গতকাল গণতন্ত্র মঞ্চ একমত হয়।

নেতাকর্মীদের বড় কর্মসূচি দেয়ার আশ্বাস মোশাররফের : তিন মাস ধরে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলে আসছিলেন, ১০ ডিসেম্বর সরকার পতনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সমাবেশে ড. খন্দকার মোশাররফ যখন যুগপৎ আন্দোলন হিসেবে ‘২৪ মার্চ গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন, নেতাকর্মীরা তখন হরতাল হরতাল বলে চিৎকার করে উঠেন। কর্মীদের থামতে বলে মোশাররফ বলেন, আপনারা যেমন কর্মসূচি চাইছেন তা দেয়া হবে। ধৈর্য ধরেন। এ সময় নেতাকর্মীদের বলতে শোনা যায়, নেতাদের পক্ষ থেকে তো দিকনির্দেশনা পেলাম না। কেউ বলেন, হুকুম দেন আজকেই নয়াপল্টন উদ্ধার করি। এত লোক একসঙ্গে আপনারা পাবেন না। বিএনপি অফিসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হয়েছে বলল গণতন্ত্র মঞ্চ : নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেভাবে হামলা, লুটপাট ও তছনছ করা হয়েছে সেটাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে অভিহিত করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা। তারা বলেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছে তা ভয়াবহ। মানুষকে উস্কানি দিয়ে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গতকাল বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিদর্শন শেষে সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন।

গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও অন্য সংগঠনের নেতাদের মধ্যে জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণতন্ত্র মঞ্চের হাসিব উদ্দিন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ডা. ফয়জুল হাকিম লালা, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, জাসদের শহীদ উদ্দীন মাহমুদ স্বপন, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর প্রমুখ নেতারা বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিদর্শন করেন। তারা প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পরিদর্শন শেষে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা অবিলম্বে খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাসসহ আটক সব নেতাকর্মীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন অনিবার্য। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বন্দি নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

মান্না বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে গণসমাবেশ শেষ করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ। তারা যা করেছে এটা নজিরবিহীন। জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভাঙা হলো। এটা কোনো সভ্য দেশে ভাবা যায়? এই ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে হবে।

সাইফুল হক বলেন, বিএনপির অফিসে যারা হামলা ও তছনছ করেছে তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে। দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিএনপির প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে সরকারের প্রতি আহ্বান, আপনারা নিজেরাও দুঃখ প্রকাশ করুন। তা না হলে গণজাগরণের মধ্য দিয়েই আপনাদের বিদায় হবে।

জোনায়েদ সাকী বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেভাবে হামলা চালিয়ে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে সেটা একেবারেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তারা জিয়ার ম্যুরাল ভাঙচুরের চেষ্টা করেছে। তারা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আসলে সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই। তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। নুরুল হক নূর বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংসদে আছেন তাদেরও পদত্যাগ করার আহ্বান জানাই। এই ফ্যাসিস্ট সরকারের অবিলম্বে পদত্যাগ ঘটাতে হবে। তা না হলে সবার ওপর আঘাত আসবে। এ সময় বিএনপির নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, কেন্দ্রীয় নেতা আমিরুজ্জামান খান শিমুল, আ ক ম মোজাম্মেল হক, মৎস্যজীবী দলের মো. আব্দুর রহিম প্রমুখ।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ  আমার সংবাদকে বলেন, বিএনপির চলমান আন্দোলনের একমাত্র অর্জন নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত মনোবল। যেটা আগে ছিল না। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, কর্মীরা সহিংস কর্মসূচি চায়, যেটা হুট করে হয় না। ধীরে ধীরে হবে। এর জন্য আগে প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হয়।

দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান আমার সংবাদকে  বলেন, ‘আমাদের গণসমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীরা ছাড়াও অসংখ্য সাধারণ মানুষও অংশ নেয়। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে আমাদের দলের নেতাকর্মীরা যে আরও বেশি সুসংঘবদ্ধ, এসব গণসমাবেশে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই এর প্রমাণ। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে চলমান আন্দোলনের সফলতা অবশ্যই আসবে। ভবিষ্যতে যে বড় কর্মসূচি আসবে তাতে শুধু বিএনপি নয় সব দল ও জনগণ একসাথে মাঠে নামবে।’

Link copied!