Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ পাঁচ ব্যাংক

রেদওয়ানুল হক

নভেম্বর ২৭, ২০২৩, ১১:৪৬ পিএম


লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ পাঁচ ব্যাংক

কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা কাজে আসছে না। এর বড় প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে পাঁচটি ব্যাংক। আবার যাদের লক্ষ্য অর্জন হয়েছে; তারাও আশ্রয় নিয়েছে নানা কৌশলের। অনেকে এনজিওর মাধ্যমে বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া সুুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গরিব কৃষক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান হাতিয়ার কৃষিঋণ। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধি করার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়ছে। লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে বেসামাল পরিস্থিতি সামাল দিতে জিডিপি ও কর্মসংস্থান প্রশ্নে ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাব কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণে জোর দেয়ার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সবগুলো ব্যাংক ঠিকভাবে সাড়া দিচ্ছে না। কিছু ব্যাংক মোটা অঙ্কের লোন দিয়ে টার্গেট পূরণ করছে, আবার কিছু ব্যাংক ঋণ বিতরণের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের খাদ্য উৎপাদনের বিস্তার ঘটাতে চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলোকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লীঋণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম চার মাসে ব্যাংকগুলো ১১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। এই সময়ে পাঁচটি ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ৫ শতাংশের কম ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে দুটি ব্যাংক কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে পুরোপুরি ব্যর্থতা দেখিয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দুটি ব্যাংক কৃষি ও পল্লী খাতে কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। ব্যাংক দুটি হচ্ছে— বেসরকারি খাতের সিটিজেন ব্যাংক ও বিদেশি ওরি ব্যাংক। এ ছাড়া তিনটি ব্যাংক এখন পর্যন্ত ৫ শতাংশও ঋণ বিতরণে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে— বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে ৫৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকা পদ্মা ব্যাংক চার মাসে মাত্রা ১৩ লাখ টাকার কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণ করেছে। আর ১৩২ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্য থাকা মধুমতি ব্যাংক বিতরণ করেছে তিন কোটি ৫১ লাখ টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ ছাড়া শরিয়াহভিত্তিক গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকটির লক্ষ্য ছিল ২৮৪ কোটি টাকা। চার মাসে ব্যাংকটি বিতরণ করেছে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে অর্থসরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কমপক্ষে ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করবে না, তাদের জরিমানার ব্যবস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে প্রতি বছরই সাধারণ ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বাড়ছে কৃষিঋণ বিতরণ। এ জন্য বছরের শুরুতে লক্ষ্যও ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। যাতে বছরের বারো মাস বিশেষ করে ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা সময়মতো ঋণ পান। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিতরণকৃত কৃষি ও পল্লীঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে তিন হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো ৮৪৪ কোটি এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে সাত হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে বিদেশি ব্যাংকগুলো। এই ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার ৮০ দশমিক ৬৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৩৩ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে লক্ষ্যমাত্রার ৩১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষিঋণ বিতরণে পরিমাণের পাশাপাশি মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যাতে সব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করে সে জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, সেসব ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার বা এনজিও মাধ্যমে বিতরণ করে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।  এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) নিবন্ধিত ক্ষদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুদ নির্ধারণেও এমআরএ নির্ধারিত সুদ হারের যাতে বেশি সুদ না নিতে পারে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।

কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি কৃষকের ফেরত দেয়া ঋণের হার সন্তোষজনক। আবার কৃষিঋণে খেলাপি কৃষকের হারও তুলনামূলক কম। তথ্য বলছে, কৃষিঋণে খেলাপির হারও ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। অক্টোবর শেষে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। এ মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মাত্র তিন হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষকরা কখনো ঋণ জালিয়াতি করেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে মাঝে মধ্যে সমস্যায় পড়েন তারা। কিন্তু দেশের বৃহৎ শিল্পগ্রুপের মতো ঋণখেলাপির প্রবণতা তাদের মধ্যে একেবারেই নেই। তবুও কৃষকদের স্বল্প অর্থের ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর ব্যাংকগুলো। মাত্র পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকার ঋণ আদায় চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মামলা করেছে ৭৪ হাজারের বেশি। তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১০ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। আর অক্টোবর শেষে এই খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই চার মাসের সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। জুলাই-অক্টোবর মাসে মোট দুই হাজার ১৯১ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। ৯৮০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। আলোচ্য চার মাসে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৬৪২ কোটি, ডাচ বাংলা ব্যাংক ৪৮৮ কোটি এবং আইএফআইসি ব্যাংক ৪৭৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পল্লী ও কৃষিঋণ বিতরণ করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৫৪১ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ ঋণ মৎস খাতে দিতে হবে। প্রথম চার মাসে এই খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ১৫ শতাংশ ঋণ দেয়ার কথা প্রাণিসম্পদ খাতে। আলোচিত সময়ে পশুসম্পদ ও পোল্ট্রি খাতে বিতরণ করা হয়েছে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এ ছাড়া চার মাস শেষে দারিদ্র্য বিমোচনে ৮২০ কোটি, শস্য খাতে পাঁচ হাজার ৩৪৭ কোটি, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭০ কোটি, সেচ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭৫ কোটি, শস্য গুদামজাত ও বিপণন খাতে ৪১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। দেশের কৃষকদের দেয়া ঋণসুবিধার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে এনজিওর মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে নেয়া ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে ২৫-৩০ শতাংশে। প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছার সক্ষমতাই দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০-৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে। এনজিওগুলো ব্যাংক থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দ্বিগুণ-তিনগুণ সুদে বিতরণ করছে।

নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করে নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবে, তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অর্থনীতির নিয়ম হলো একটি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অন্যটি ছাড় দিতে হয়। যেহেতু বর্তমানে প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি তাই এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে জিডিপিতে ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে হয়তো উৎপাদন ও কর্মসংস্থান কমে যাবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাদের এটি মেনে নিতে হবে। তবে বড় ধরনের প্রভাব ঠেকাতে কৃষি, সিএমএসএমই ও ক্ষুদ্র ঋণে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’
 

Link copied!