নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ১৬, ২০২৫, ১১:৪৩ পিএম
পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না দেশের কয়লাভিত্তিক চারটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মূলত সঞ্চালন সীমাবদ্ধতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত জ্বালানির (কয়লা) অভাব, বকেয়া বিল ও রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও ওইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে তা পূরণ করা হচ্ছে। তাতে বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার বড় অংশ।
যদিও বেজ লোড বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকার কথা ছিল কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো। বর্তমানে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৭ হাজার ৯৫ মেগাওয়াট। যদিও গ্রিডের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আর ওসব কাজ শেষ হলেই কয়লাভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রাখা সম্ভব হবে। বিপিডিবি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চারটি বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৪ হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট। তার মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (যদিও প্রকৃত সক্ষমতা ১ হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট), বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ারের ৩০৭, পটুয়াখালীর পায়রায় আরপিসিএল-নরিনকোর ১ হাজার ৩২০ ও বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলার কথা থাকলেও চলতি বছর খুব সীমিত সময় তা পূর্ণ সক্ষমতায় চলেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত বিসিপিসিএল ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে মাত্র ৬১ দিন চলেছে, আর রামপালে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) ২৭ দিন ও বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার ৩০ দিন চলেছে। তাছাড়া প্রায় ছয় মাস আগে পুরোপুরি প্রস্তুত হলেও আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল) এখনো বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসেনি। যদিও গত জানুয়ারি থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী কেন্দ্রটি ৫০ দিন ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলেছে।
সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মতৎপতার সম্ভাব্য বিকাশকে বিবেচনায় নিয়ে ওই অঞ্চলে নির্মাণ করা হয় আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র। কারণ শিল্পায়ন হলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে ব্যাপক হারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তেমন শিল্পায়ন না হওয়ায় বাড়েনি বিদ্যুতের চাহিদাও। ফলে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ ঢাকায় এনে তা জাতীয় গ্রিডে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু ও উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার পর গ্রিড সীমাবদ্ধতার কারণে পূর্ণ সক্ষমতায় কেন্দ্রগুলো চালানো যাচ্ছে না। কারণ ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে কেন্দ্রগুলো চালানো হলে গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা যায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।
বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিড দিয়ে ঢাকায় আনার জন্য মোংলা থেকে মাওয়া হয়ে সাভারের আমিনবাজার পর্যন্ত ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। যেটি মোংলা-মাওয়া-আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নামে পরিচিত। সূত্র আরও জানায়, পিজিসিবি মেরিট অর্ডারের ভিত্তিতে কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের চাহিদা ও সাশ্রয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকলে কিংবা উৎপাদন ব্যয় বেশি হলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কম নেয়া হয়। ফলে সবসময় কেন্দ্রগুলো ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে না। আর বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সবই বেজ লোডভিত্তিক।
কিন্তু জ্বালানিস্বল্পতা, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কেন্দ্রগুলো সার্বক্ষণিক চালানো সম্ভব হয় না। দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও বিদ্যুতের তীব্র চাহিদায় সর্বোচ্চ গড়ে চার হাজার মেগাওয়াট চালানো যায়। বাকি সক্ষমতা জ্বালানি সংকট, রক্ষণাবেক্ষণ এমনকি বিল বকেয়ার মতো কারণে কাজে লাগানো যায় না।
এ বিষয়ে গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান ড. এম রেজওয়ান জানান, দক্ষিণাঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে শুধু যে সঞ্চালনগত সমস্যা তা নয়। সেখানে কয়লা খালাস ও জ্বালানি আমদানির সংকটও রয়েছে। তবে ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে কেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় যে সঞ্চালন অবকাঠামো প্রয়োজন, সেগুলোর কাজ তিন-চার মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তখন পূর্ণ সক্ষমতায় কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে।
একই বিষয়ে বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. জহরুল ইসলাম জানান, কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্টগুলোর মোটা দাগে তিনটি সংকট রয়েছে। যে কারণে সেগুলো সার্বক্ষণিক চালু থাকার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয় না।
প্রথমত, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর মতো প্রয়োজনীয় কয়লার মজুত না থাকা; দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রগুলোর বকেয়া যথাসময়ে পরিশোধ করা না গেলে কয়লা আমদানিতে বিলম্ব এবং তৃতীয়ত, গ্রিড সক্ষমতা পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়া। তার বাইরে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সার্বক্ষণিক চালু থাকলে অন্তত ২০ শতাংশ ক্যাপাসিটি রক্ষণাবেক্ষণে থাকে।