Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪,

ব্যাংকের শীর্ষ কর্তারা আতঙ্কে

রেদওয়ানুল হক

ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩, ১১:৫৩ এএম


ব্যাংকের শীর্ষ কর্তারা আতঙ্কে
  • ব্যাংকের শীর্ষ কর্তারা আতঙ্কে
  • মালিকপক্ষের চাপে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন
  • অনেকে দেশ ছেড়েছেন কেউ হয়েছেন গ্রেপ্তার
  • অনিয়মে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে, শঙ্কিত ক্লিন ইমেজধারীরা
  • অনৈতিক আদেশ পালন না করলেই বিপত্তি —বলছেন সংশ্লিষ্টরা

 

আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকাররা। শীর্ষ কর্মকর্তারা আছেন বেশি ঝুঁকিতে। মালিকপক্ষের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশীদার না হলেই ঘটছে বিপত্তি। চাপের মুখে ইতোমধ্যে অনেকে চাকরি ছেড়েছেন। অনেকে ছেড়েছেন দেশ। আবার অনেকে হয়েছেন গ্রেপ্তার। টালমাটাল আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যেই এমন চিত্র ব্যাংক খাতের অস্থিরতা আরও বাড়িয়েছে। এর আগে করোনা মহামারির সময় বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অপছন্দের তালিকায় থাকা হাজার হাজার কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরও তারা চাকরি ফেরত পাননি। তাদের অনেকে আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছেন।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের আতঙ্কের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন বেসরকারি খাতের শরিয়াহ-ভিত্তিক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) চেয়ারম্যান মাহবুব-উল-আলম ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা

পরিচালক (এএমডি) আবু রেজা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। তবে ব্যাংক সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে— মালিকপক্ষের করা অনিয়মে অংশীদার হতে রাজি না হওয়ায় তাদের সরে যেতে হয়েছে। তারা শুধু দায়িত্বই ছাড়েননি; বরং দেশও ছেড়েছেন। কারণ এর আগে ব্যাংকটির মালিকানায় থাকা গ্রুপের অন্য একটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। গ্রেপ্তার কর্মকর্তারা হলেন— মো. সাইদ উল্লা, মো. মোশাররফ হোসেন, শহিদুল্লাহ মজুমদার ও ক্যাপ্টেন (অব.) হাবিবুর রহমান। তারা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত। ব্যাংকটির আরও কিছু কর্মকর্তাকে সন্দেহের মধ্যে রেখে অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানায় ডিবি। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেয়া হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাংকটির স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি আরেকটি ঘটনা ব্যাংক খাতে আলোড়ন তৈরি করেছে। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার মেহমুদ হোসেন ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি এবং সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হস্তক্ষেপে এক সপ্তাহ পর তিনি আগের পদে ফিরে আসেন। এর আগে ব্যাংকটির বেশ কয়েকজন এমডিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে মালিকপক্ষের চাপে। ব্যাংকাররা বলছেন, একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়া বেশির ভাগ ব্যাংকারের জন্য ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু এই কর্মজীবনের পথটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের পদত্যাগের সামপ্রতিক প্রবণতা দ্বারা স্পষ্ট। তারা বলছেন, সবাই মেহমুদ হোসেনের মতো সৌভাগ্যবান নয়। গত কয়েক বছরে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ডজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন বা স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। এটি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। কারণ, এই খাতে ইতোমধ্যে দক্ষ এবং যোগ্য এমডি ও সিইওদের সঙ্কট রয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান গণমাধ্যমে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘মূলত সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দুই-তিনটি বাদে প্রায় সব ব্যাংকই কর্পোরেট গভর্নেন্সের অভাবে ভুগছে, যা চলমান পরিস্থিতির মূল কারণ। মেহমুদ হোসেনের পদত্যাগের আগে, ন্যাশনাল ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারী ২০২১ সালের নভেম্বরে তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। খন্দকার রাশেদ মাকসুদ গত জানুয়ারিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও হিসাবে তার তিন বছরের চুক্তি শেষ করার পর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড ছেড়েছেন। তিনি সমপ্রতি জানিয়েছেন, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগদানের কোনো পরিকল্পনা তার নেই। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন এমডি তাদের দায়িত্ব ছেড়েছেন। এর মধ্যে মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। মোহাম্মদ নুরুল আমিন মেঘনা ব্যাংক থেকে, তরিকুল ইসলাম চৌধুরী এবং মো. গোলাম ফারুক তাদের মেয়াদ শেষ করার আগে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তাদের বেশির ভাগই পদত্যাগের জন্য ব্যক্তিগত কারণ বা স্বাস্থ্যের অবনতির কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ ব্যাংকের এমডির পদ ছেড়ে পরে উদ্যোক্তা হয়েছেন। তাদের একজন আরফান আলী, যিনি গত বছরের আগস্টে তার ব্যাংকিং চাকরি ছেড়ে দেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আরফান আলী শুরু থেকেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সক্রিয় থাকার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। এখন, তিনি জায়তুন বিজনেস সলিউশনের চেয়ারম্যান। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামে ডিজিটাল বুথ স্থাপন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকে প্রযুক্তিভিত্তিক আর্থিক পরিষেবার আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার কাজের স্বাধীনতা খুঁজে পেতে উদ্যোক্তা হয়েছেন। অর্থাৎ ব্যাংকে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিলেন না।

এ ছাড়া রাহেল আহমেদ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তারপর সিইও হিসেবে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারে ‘নগদ’ যোগদান করেন। তিনি গত বছরের আগস্টে সেই পদটি ত্যাগ করেন এবং অবশেষে একটি স্টার্টআপ চালু করেন। যার লক্ষ্য একাধিক শিল্পের কর্মচারীদের জন্য অর্জিত বেতনের বিপরীতে তাদের তাৎক্ষণিক আর্থিক প্রয়োজনসমূহ সমাধানের জন্য কাজ করা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান মনে করেন, ‘যখন একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও চেয়ারম্যান অনৈতিক চর্চায় জড়িয়ে পড়ে, তখন একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকের কিছু পর্ষদ সদস্য ব্যাংকিং কার্যক্রম, ক্রয় ও নিয়োগের মতো ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত হচ্ছে। এ ধরনের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ অনুমোদন ও অন্যান্য প্রধান সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপনার ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। ফলে, স্থানীয় এবং বিদেশি অভিজ্ঞতা আছে এমন সিনিয়র ব্যাংকাররা চাপ অনুভব করেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা চাকরি ছেড়ে দেন।’ আনিস এ খান মনে করেন, ব্যাংকিং সেক্টরে কর্পোরেট গভর্ন্যান্স আনা অপরিহার্য। একটি ব্যাংকের পর্ষদে স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সুশাসনের পক্ষে তাদের আওয়াজ তুলতে ক্ষমতাবান হতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সামপ্রতিক সময়ে পদত্যাগ করা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকে কাজ করেছেন। যেসব ব্যাংকে সুশাসন রয়েছে সেখানে এমডি এবং সিইওরা নিরাপদ। এমন পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেকটা দায়ী। কারণ নিয়ন্ত্রকের উচিত ছিল সেই ব্যাংকারদের রক্ষা করা কিন্তু তারা তা করেনি। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালে এমডি এবং সিইওদের সুরক্ষার জন্য একটি সার্কুলার জারি করেছিল। যাতে বলা হয়েছিল, যদি কোনো এমডি মেয়াদের আগে পদত্যাগ করতে চান তবে তাকে এক মাস আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কারণসহ একটি আবেদন জমা দিতে হবে। পদত্যাগের সময় বেশির ভাগ এমডিই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নিয়ম অনুসরণ করেননি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান করেনি।

Link copied!