Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

ডিপিডিসির আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল প্রকল্প

তারের জঞ্জাল সরছে কচ্ছপগতিতে

মহিউদ্দিন রাব্বানি

সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩, ১১:৫৭ পিএম


তারের জঞ্জাল সরছে কচ্ছপগতিতে
  • এখনও কাজ বাকি ৫৮ শতাংশ
  • ১৩৫৩ কিলোমিটারের কাজ করেছে ডিপিডিসি
  • ২০২০ সালের কাজ শেষ হবে ২০২৭ সালে

গ্রাহকসেবা বৃদ্ধির পাশাপাশি সিস্টেমলসও কমে আসবে
—বিকাশ দেওয়ান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিপিডিসি

ক্যাবল সরানো শেষ হলে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে পাশাপাশি মানুষের নিরাপত্তাও নির্বিঘ্ন হবে

—হাবিবুর রহমান
সিনিয়র সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ

করোনাকালে কাজ বন্ধ থাকায় সময় একটু বেশি লাগছে
—আবদুল্লাহ নোমান
প্রকল্প ও নির্বাহী পরিচালক, ডিপিডিসি

নগরজুড়ে তারের জঞ্জাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণও গেছে বহুজনের। এলোমেলোভাবে ঝুলে থাকা এসব তারের কারণে বারবার ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় বড় দুর্ঘটনা। নিরাপদ বসবাস উপযোগী করতে উন্নত বিশ্বের মতো ভূগর্ভস্থ করা হচ্ছে রাজধানীর বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ডিশ, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের ক্যাবল। চীনের জি টু জি প্রজেক্টের আওতায় দেশটির এক্সিম ব্যাংকের ঋণসহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। কাজ কিছুটা এগিয়ে গেলেও প্রকল্পটির কার্যক্রম চলছে কচ্ছপ গতিতে। 

জানা যায়, ২০২০ সালে বিদ্যুতের তার ভূগর্ভস্থ করার কাজ অনুমোদন পায় ডিপিডিসি। শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। করোনা মহামারিসহ নানা কারণে এ প্রকল্প গতি হারায়। পরে ২০২৭ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। খরচ ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এতে এক লাখ ১৫ হাজার গ্রাহক সেবা পাবেন। চীন সরকারের সঙ্গে জি টু জি পদ্ধতিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাইলটিংয়ে সফলতা মিললে বড় পরিসরে কাজ করবে সরকার।

ডিপিডিসি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিবিএইএর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে প্রকল্পের নকশা সম্পন্ন  দ্যুৎ বিভাগের সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চীন ঋণের অর্থ ছাড় করতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটি পিছিয়ে গেছে। ‘এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি’ প্রকল্পটির আওতায় ডিপিডিসির দুটি ভবন, সাব-স্টেশন, হাতিরঝিল ও ধানমন্ডিতে আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন নির্মাণের কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্য ঋণ সহায়তা ১৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব খাত থেকে পাঁচ হাজার ৫৩৬ কোটি এবং ডিপিডিসির নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে এক হাজার ১২০ কোটি টাকা। ডিপিডিসির ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প।

নগরবাসী জানায়, নগরের প্রতিটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে মাকড়শার জালের মতো তারের জঞ্জাল দেখা যায়। এর মধ্যে টেলিফোন, ডিশ, ইন্টারনেটের তারও রয়েছে। এলোপাতাড়ি এসব তারের কারণে সুন্দর আকাশও দেখা যায় না। প্রাথমিকভাবে বঙ্গভবন থেকে জাহাঙ্গীর গেট, গাবতলী থেকে আজিমপুর পর্যন্ত রাস্তার ওভারহেড বিতরণ লাইনকে আন্ডারগ্রাউন্ড করার কাজ চলছে। 

রাজধানীকে বৈদ্যুতিক তারের জঞ্জালমুক্ত করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে ডিপিডিসির আওতাধীন সব বিরতণ লাইন মাটির নিচে বসানো হবে। ধানমন্ডি এলাকার কাজের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এ প্রকল্পের কাজ। এরপর হাতিরঝিলে আন্ডার ক্যাবল স্থাপনের কাজ শুরু করে, যা এখন প্রায় শেষদিকে। ২০১৬ সালে জি টু জি চুক্তি হলেও দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২২ সালে ২৩ নভেম্বর আলোর মুখ দেখল প্রকল্পটি। 

সূত্র জানায়, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় ১৩৫৩ কিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভস্ত বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন বসবে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও বাকি অর্ধেকেরও বেশি কাজ। তবে হাতিরঝিলের কাজ প্রায় শেষ। এদিকে শুধু ধানমন্ডি এলাকার কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা।

ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমরা এ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, আমাদের হাতে সময় আছে। আমরা চেষ্টা করব নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যেন কাজ শেষ হয়। আমাদের এখন প্রায় ১২০০ কিলোমিটারের মতো ভূগর্ভস্থ লাইন আছে। সব ওভারহেড লাইন মাটির নিচে নিয়ে যাব।

ডিপিডিসি বলছে, প্রাথমিকভাবে জাহাঙ্গীর গেট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ২২টি আরএমইউ, ১৯টি এলটিবি এবং চারটি কিয়স্ক ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হবে। এ কাজ বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ডিপিডিসির অর্থায়নে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএনটিআইসি ও এসপিআইটিসি যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

এর আগে ২০২০ সালে এক সভায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দেশের সব শহরে পাঁচ বছরের মধ্যে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা (আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল) গড়ে তোলা হবে। 
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, পুরো সিলেট শহর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ মহানগরকেও আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের আওতায় আনা হবে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে শহরাঞ্চলে বিতরণ ব্যবস্থা মাটির নিচে যাবে। 

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাইলটিং কাজের অংশ হিসেবে ধানমন্ডির ৩, ৬, ৭/এ, ১১/এ সড়কে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন মাটির নিচে স্থাপন করা হচ্ছে। অভিজাত এ আবাসিক এলাকাকে চারটি ভাগে ভাগ করে কাজ করছে ডিপিডিসি।

এর আগে দেশে প্রথমবারের মতো মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম চালু হয়েছে সিলেটে। ইতোমধ্যে শহরের হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এলাকার সড়কের ওপরে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নগরে তারের জঞ্জাল কমাতে টেলিফোন, ইন্টারনেট, ক্যাবল লাইনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সব তার ভূগর্ভে নেয়া হবে বলে জানা যায়।

বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ডিপিডিসির এক হাজার ২৮৭ কিলোমিটার, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) এক হাজার ৩৬৬ কিলোমিটারসহ বিভিন্ন সংস্থা বা কোম্পানির প্রায় দুই হাজার ৬৯২ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ লাইন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পবিবো) আট হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ বিতরণ লাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ করছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা, বরিশাল ও যশোরে দুই হাজার ৬১ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। 

শহর এলাকায় অপ্রশস্ত ও জনবহুল রাস্তার পাশে ট্রান্সফরমার, রিং মেইন ইউনিট (আরএমইউ) ইত্যাদি স্থাপনে স্থানের অপ্রতুলতা রয়েছে। প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরের রাস্তায় বিভিন্ন ইউটিলিটির ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন ও ক্যাবল বিদ্যমান থাকায় বৈদ্যুতিক ক্যাবল স্থাপনের জন্য রুট নির্ধারণ একটি দুরূহ কাজ। সব ইউটিলিটি একটি নির্দিষ্ট লাইন নির্মাণ করে ক্যাবল স্থাপন করতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের খরচ ওভারহেড নির্মাণের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এজন্য সব বিভাগীয় শহরের লাইন আন্ডারগ্রাউন্ডে স্থাপনে অর্থায়ন করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। 

ভূগর্ভস্থ ক্যাবল নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক ও ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) আবদুল্লাহ নোমান চলমান এ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, মানুষের নিরাপত্তা বিবেচনায় এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলমান হাতিরঝিল এলাকায় কাজটি প্রায় শেষের দিকে। এখন পর্যন্ত সেখানের কাজ প্রায় ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। তবে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে। 
তিনি আরও বলেন, কারোনাকালীন সময়ে কাজ প্রায় এক বছর বন্ধ ছিল। এ জন্য আমরা পিছিয়ে গেছি। আমরা ধাপে ধাপে কাজ করছি। পুরো প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত ৪২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হতে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি পার হতে পারে। 

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, আমরা শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে গ্রাহকসেবা নির্বিঘ্ন করতে চাই। এছাড়া এতে সিস্টেমলসও অনেক কমে আসবে। এজন্য ক্রমান্বয়ে ওভারহেড লাইনগুলোকে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুরুতে ধানমন্ডির একটি এলাকার পাশাপাশি হাতিরঝিলের কাজ চলছে। ক্রমান্বয়ে অন্য এলাকার লাইনগুলোও মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা দ্রুততার সঙ্গে এর কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। 

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ঝড়বৃষ্টি হলে অনেক সময় বৈদ্যুতিক তার মানুষের ঘরবাড়ির ওপর এসে পড়ে। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। একদিকে সৌন্দর্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে মানুষের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাবে। সে বিবেচনায় আন্ডার ক্যাবল প্রকল্পের কাজ চলছে। 
 

Link copied!