ইয়ামিনুল হাসান আলিফ
আগস্ট ২০, ২০২৫, ১২:৩১ এএম
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে নেয়া হচ্ছে উদ্যোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ফার্স্ট ডিফেন্স হবে উপকূলীয় বনায়ন—মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রধান বন সংরক্ষক
পরিবেশ সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন অধিদপ্তর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলা, বনাঞ্চল বৃদ্ধি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সংস্থাটির নানা উদ্যোগ আজ আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হচ্ছে। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প, ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা কার্যক্রম এবং পাহাড়ি অঞ্চলে বৃক্ষরোপণের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ বন অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যক্রম।
বন অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক কার্যক্রমগুলো বিভিন্ন মহলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকায় ‘স্মার্ট বন ব্যবস্থাপনা’ চালুর মাধ্যমে বন সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ড্রোন ক্যামেরা, জিপিএস ট্র্যাকিং এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন অবৈধ কাঠ কাটা ও চোরাশিকার কার্যক্রম রোধে বন অধিদপ্তরের অধীনে বন বিভাগের সক্ষমতা অনেকগুণ বেড়েছে।
বন অধিদপ্তরের পরিকল্পনা রয়েছে পুরো ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ডিজিটালাইজেশন করার।
এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘পুরো বন ব্যবস্থাপনা স্মার্ট বা ডিজিটালাইজেশন করার বিকল্প নেই। সারা দেশের ১০.৭৮ শতাংশ জমি বন বিভাগ দেখে। এত বড় জমি ব্যবস্থাপনা করার জন্য ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োজন। আগে বাউন্ডারির পিলারগুলো চুরি হয়ে যেত। যদি জিপিএস সিস্টেম আমরা সেখানে ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে। আমাদের এ বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে।
বন অধিদপ্তরের অধীনে চালু রয়েছে বাংলাদেশ ফরেস্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, যার মাধ্যমে দেশজুড়ে বনজ সম্পদ ডিজিটাল ডাটাবেজে রক্ষণাবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। এই সিস্টেমের ফলে বনভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি এসেছে এবং অনিয়ম ও বন দখল প্রতিরোধে কার্যকর নজরদারির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণেও রয়েছে বন অধিদপ্তরের দৃশ্যমান অগ্রগতি। বিলুপ্তপ্রায় বাঘ, হরিণ ও অন্যান্য প্রজাতি রক্ষায় নতুন অভয়ারণ্য ও সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১২৫টি, যা ২০১৫ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
সামাজিক বনায়ন, প্রযুক্তিনির্ভর বন ব্যবস্থাপনা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং সুন্দরবনের নিরাপত্তা জোরদারে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সংস্থাটি পরিবেশ সুরক্ষা এবং জনসম্পৃক্ততার এক শক্তিশালী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বন অধিদপ্তর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন অধিদপ্তর সামাজিক বনায়নকে গুরুত্ব দিয়ে পরিচালনা করছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় গড়ে উঠছে অংশগ্রহণমূলক বনায়ন প্রকল্প, যেখানে স্থানীয় জনগণ সরাসরি জড়িত হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও মুনাফা বণ্টন প্রক্রিয়ায়। এতে পরিবেশের উন্নয়ন যেমন নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি ভূমিহীন ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। সামাজিক বনায়ন এবং সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় নারীদের সম্পৃক্তকরণের ফলে যেমন দেশের পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে তেমনি আর্থিকভাবেও লাভবান হতে পারছে জনগণের একটি বড় অংশ।
বন বিভাগ পরিচালিত সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী নির্বাচনে সমাজের দুস্থ মহিলাদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে। উপকারভোগী ব্যক্তি বিবাহিত পুরুষ হলে তার স্ত্রীকেও উপকারভোগীর মর্যাদা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া রক্ষিত এলাকা পাহারার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে গঠিত কমিউনিটি পেট্রোল গ্রুপেও নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বপ্রথম সফল উপকূলীয় বনায়নকারী দেশ।
উপকূলীয় জনগণের আরও অধিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ বন বিভাগ উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা নতুন চরে ১৯৬৬ সাল থেকে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু করে। উপকূলজুড়ে গ্রিন বেল্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে বন অধিদপ্তরের জানিয়ে আমার সংবাদকে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, এটি হবে উপকূলীয় অঞ্চলের ফার্স্ট ডিফেন্স। দেশে নতুন নতুন চর জাগলেই আমরা ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু করছি। যা ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।
এছাড়া গত মাসেই জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে তাদের স্মরণে ‘এক শহীদ এক বৃক্ষ’ কর্মসূচির আওতায় ফলদ, ঔষধি, বনজ ও শোভাবর্ধনকারী গাছ রোপণ করা হয়। এ কর্মসূচিতে প্রতিজন শহীদের সম্মানে একটি করে বৃক্ষরোপণ করা হয়। ৬৪টি জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে বন অধিদপ্তর সারা দেশে বৃক্ষরোপণ করে। বন অধিদপ্তরের অধীনে বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তকরণের চেষ্টাও চলছে। তরুণ ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বনায়ন সহজ হবে ও বনজ সম্পদ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই সহজ হবে বলে মনে করছে বন অধিদপ্তর।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, এ বছর আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে পাঁচ হাজার শিক্ষাঙ্গনে বৃক্ষরোপণ করব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পেলেই সেগুলো আমরা রোপণ করব এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে শিক্ষার্থীরা। বন, পরিবেশ সংরক্ষণে একমাত্র তরুণ ও শিক্ষার্থীরাই পারে হাল ধরতে। আমাদের বন উজার, বন নিধনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে শিক্ষার্থীরা।
বন অধিদপ্তরের বহুমাত্রিক উদ্যোগ আজ শুধু বন সংরক্ষণেই নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, মানুষের জীবিকায়ন, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বেও একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি মডেল সবুজ রাষ্ট্র।