Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪,

সুপার সাইক্লোন সিডরের ১৬ বছর

হস্তান্তরের আগেই ২৪২ কোটি টাকার বাঁধে ভাঙন

এইচ এম মইনুল ইসলাম, বাগেরহাট

এইচ এম মইনুল ইসলাম, বাগেরহাট

নভেম্বর ১৪, ২০২৩, ০৭:১৩ পিএম


হস্তান্তরের আগেই ২৪২ কোটি টাকার বাঁধে ভাঙন

সুপার সাইক্লোন সিডরের ১৬ বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল ১৫ নভেম্বর। টেকসই বেড়িবাঁধ হস্তান্তরের আগেই ভাঙন দেখা দেওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে শরণখোলাবাসীর মাঝে। ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধের একাধিক স্থানে ফাটল ধরেছে। প্রায় ৭শ’ মিটার বাঁধের ব্লক ধ্বসে বিলীন হচ্ছে বলেশ্বর নদীতে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অন্তত ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। হস্তান্তরের আগেই এমন অবস্থা হওয়ায় চিন্তিত এলাকাবাসী। নদী শাসন প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাগেরহাটসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলা। সরকারি হিসেবে এ দিনে প্রায় ৯০৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সিডরের আঘাতে। আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল কয়েকশ কোটি টাকা। স্বজন হারানো বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে শরণখোলা-মোরেলগঞ্জবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ।

গণমানুষের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৫ সালে ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মান শুরু হয়। বেড়িবাঁধের ৯৫ শতাংশ কাজ শুরু হয়েছে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বাঁধ হস্তান্তরের আগেই শরণখোলা উপজেলার বগী, গাবতলা, মোরেলগঞ্জের আমতলা এলাকা থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে। বাঁধের ব্লক ধ্বসে বিলীন হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও বেশকয়েকটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। হস্তান্তরের আগেই এমন অবস্থা হওয়ায় চিন্তিত এলাকাবাসী।

শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বারেক বলেন, বলেশ্বর নদীর ভাঙনে আমার ও পরিবারের প্রায় ১৫০ বিঘা জমি হারিয়েছি। সিডরে স্বজন হারিয়েছি। বাঁধ নির্মাণ শুরু হলে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভাঙন ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাব। সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রুপ নিয়েছে। টেকসই বেড়িবাঁধেই ভাঙন শুরু হয়েছে। যেকোন মুহুর্তে বড় ধরণের ভাঙন শুরু হবে। এখন মনে হচ্ছে বিপুল টাকার এই বাঁধ আমাদের কোন কাজে আসবে না।


গাবতলা এলকার আ. রহিম দুলাল বলেন, বাঁধ নির্মাণের শুরুতেই আমরা নদী শাসনের দাবি করেছিলাম। এজন্য সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছিলাম। তারপরও নদী শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করেছে সিইআইপি প্রকল্প। এখন বাঁধে ভাঙন শুরু হয়েছে, ফসলি জমি, গাছপালা, বসত ঘর ঝুকির মধ্যে রয়েছে।

ফসিয়াতলা এলাকার গফার তালুকদার বলেন, প্রতিনিয়তই ভাঙনে ধ্বসে পড়ছে টেকসই বাঁধের ব্লকগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন বন্ধের চেষ্টা করলেও, কোন কাজে আসছে না। নদীতে পানির গভীরতা ৫০ থেকে ৬০ হাতের উপরে। সরকারের কোটি কোটি টাকা জলেই যাচ্ছে।

এদিকে ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলে কোন কাজে আসছেনা বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারের প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গেল ১৫ দিনে গাবতলায় ভাঙনরোধে ২০০ মিটার জায়গায় ১৪ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তারপরেও ভাঙন রোধ হচ্ছে না। এখানে কংক্রিটের ব্লক ফেলানো জরুরি বলে জানান তিনি।
শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, সিডরের পরে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিআইপি প্রকল্পের দূরদর্শিতার অভাবে নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণের ফলে আজ বাঁধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভাঙন ও ফাটল দেখা দিয়েছে। আমাদের আবারও দাবি খুব শীঘ্রই নদী শাসন করে বাঁধটি টেকসই করতে হবে।

সিইআইপি প্রকল্পের মাঠ প্রকৌশলী মো. রাকিবুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে কাজ হস্তান্ত করা হবে। তবে বলেশ্বর নদীর স্রোত তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমরা মাঠে থেকে পর্যবেক্ষণ করে কাজ করছি। তবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী শাসন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান এ প্রকৌশলী।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। নদীর গভীরতা ও স্রোত বেশি থাকায় ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় নদী শাসনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে ভাঙনের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

উল্লেখ্যে, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাতে উপকূলীয় শরণখোলার ৩৫/১ পোল্ডারের প্রায় ২০ কিমি. বেড়িবাঁধ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ২২০ কিমি. বেগের ঘূর্ণিঝড় আর ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায় বিশ গ্রামের মানুষের ঘর-বাড়ি,গাছপালা ও রাস্তাঘাট।

বলেশ্বর নদ তীরবর্তী বগী, দক্ষিণ সাউথখালী, উত্তর সাউথখালীসহ ৫টি গ্রামের প্রায় ১২শ মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো শিশু ও নারী। গবাদি পশু মারা যায় দশ সহাস্রাধিক। মাছের ঘেরসহ আমনের ক্ষেত যায় ভেসে। বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাড়াতে সেদিন সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ বিদেশীরাও বিভিন্ন সাহায্য নিয়ে ছুটে আসেন। সর্বহারা মানুষ  ধ্বংস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেদিন দাবি জানায় ত্রাণ চাইনা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই।

ভুক্তভুগীদের দাবির সঙ্গে একাত্বতা জানিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাগেরহাটের শরণখোলা-মোরেলগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিমি. জায়গাজুড়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।

জানা যায়, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ্যায়নে পরিচালিত উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) অধীনে বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি। কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পান সিএইচডব্লিউ নামের চীনের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।

২০১৯ সালে সালের  জানুয়ারি মাসে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বর্ধিত সময়ানুযায়ী কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। ৬২ কিমি. বাঁধের শরণখোলার সুন্দরবন সংলগ্ন বগী গ্রাম থেকে মোরেলগঞ্জের ফাসিয়াতলা পর্যন্ত মোট ২০ কিলোমিটার  নদী তীর এলাকা  ভাঙন কবলিত।

এআরএস

Link copied!