‘ক্লান্ত জীবনের মাঝে একটুখানি শান্তি’ 

ঈদ শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে শিকড়ে ফেরার উৎসব, ক্লান্ত জীবনের একটুখানি বিরতি, কিংবা আত্মিক প্রশান্তির এক অপূর্ব উপলক্ষ্য। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) শিক্ষার্থীদের কাছে ঈদ মানেই শুধু নামাজ, কোলাকুলি বা নতুন জামার আনন্দ নয়, বরং তা হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের খোঁজে ফেরার এক প্রগাঢ় যাত্রা। 

সারা বছর ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট আর টিউশনি—সবকিছুর ভিড়ে নিজেদের খুঁজে পাওয়াটাই যেন দুরূহ হয়ে পড়ে। সময় থাকে না নিজেদের দিকে ফিরে তাকাবার, প্রিয়জনের সঙ্গে বসে নিশ্বাস নেবার। দিন শেষে যান্ত্রিক শহরের যানজটে, টিকিট না পাওয়ার উৎকণ্ঠায় অথবা বাসে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত শরীরেও থাকে একটিই আশ্রয়—ঈদের ছুটি মানে বাড়ি ফেরা। 

বাড়ি ফেরা: এক অন্তর্গত তাগিদ 

মহসিন হক শাহ, ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ

মহসিন হক শাহ বলেন, “বাড়ি ফেরার এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা আসলে শিকড়ে ফেরার এক অন্তর্গত তাগিদ। প্রতিবার ঈদ এলেই আমরা যেন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই—লঞ্চ, ট্রেন বা বাসের টিকিট পাওয়ার জন্য রাত জেগে লাইনে দাঁড়ানো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। অনেক সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থেকে যায়, প্রাণও যায়। তবুও আমরা থেমে থাকি না। কারণ এই যাত্রার শেষে রয়েছে মায়ের হাতের রান্না, ছোটবেলার উঠোন, এবং প্রিয়জনদের কাছে থাকার এক অদ্বিতীয় প্রশান্তি।

শহরে থেকেও যারা মনেপ্রাণে গ্রামীণ, তাদের কাছে ঈদ মানে শিকড়ের সন্ধান। শিক্ষার্থীদের এই ছোট্ট যাত্রা তাই হয়ে ওঠে আত্মার আরাম, ভেতরকার অস্থিরতার ওষুধ। 

ঈদ: ভালোবাসা ও সম্পর্কের মহোৎসব 

আসাদুল্লাহ আল গালিব, ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ

সময় যত কঠিন হোক না কেন, ঈদ আমাদের মনে আনন্দের আলো ছড়ায়, "বলেন আসাদুল্লাহ আল গালিব। তাঁর মতে, এই উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভালোবাসা ও সম্পর্কই জীবনের আসল সৌন্দর্য। সারাবছরের যান্ত্রিকতা ভুলিয়ে দেয় এই কয়েকটা দিন। ঈদ মানেই নতুন পোশাক, মিষ্টি খাবার বা সামাজিক যোগাযোগ নয়—ঈদ মানে একসঙ্গে থাকা, আত্মীয়স্বজনকে জড়িয়ে ধরা, সম্পর্কগুলোকে নতুন করে আবিষ্কার করা।”

শিক্ষার্থীদের জীবনে ঈদ এমন এক সময়, যখন তারা পরিবারকে সময় দিতে পারে, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারে, এমনকি নিজের ভেতরকার মানুষটির সঙ্গেও কথা বলতে পারে। 

অসাম্যের ভিড়ে সাম্যের ঈদ 

কিন্তু ঈদের আনন্দ সবার জন্য সমানভাবে ধরা দেয় না। কিছু মানুষের ঈদ হয় অনেক বেশি নিঃস্ব, তবুও অনেক বেশি হৃদয়ছোঁয়া। 

আরিফ আহমেদ, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ

আরিফ আহমেদ এমনই এক বাস্তব গল্প শোনান—গাজীপুর শহরের রাস্তায় ফুল বিক্রি করা ১২ বছরের রনি। মা ও ছোট বোনকে নিয়ে টঙ্গীর একটি বস্তিতে বসবাস করে সে। ঈদের আগের দিন, এক পথচারীর দেওয়া ১০০ টাকাই তার সবচেয়ে বড় উপহার। সেই টাকায় সে ছোট বোনের জন্য ফিতে কেনে এবং মায়ের জন্য দুধ-সেমাই নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।

আমাদের হাজার টাকার কেনাকাটার মাঝেও রনির এই ছোট্ট পরিকল্পনাই যেন হয়ে ওঠে ঈদের সবচেয়ে বড় আনন্দ। তার মতে, এই ধরনের শিশুদের জন্য ঈদ শুধু নতুন জামা নয়, বরং একজন মানুষের কাছ থেকে পাওয়া একটুখানি সম্মান, সহানুভূতি এবং ভালোবাসা।

এই গল্প যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সামান্য একটু মানবিকতা কারও ঈদের সকালটাকে ভরে দিতে পারে আলোর ঝলকে। 

সাম্যের বার্তা: একসাথে খাওয়া, হাসা ও ভালোবাসা 

এহসান ইসলাম, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ

এহসান ইসলাম মনে করেন, ঈদ কেবল ব্যক্তিগত আনন্দ নয়, বরং সামাজিক সাম্যের প্রতীক। ঈদের আনন্দ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সমাজের সব স্তরের মানুষ একসাথে হাসে, খায় এবং ভালোবাসে। এই উৎসব আমাদের শেখায় কৃতজ্ঞতা, সংযম এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ।”

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আজকাল শুধু নিজেরা ভালো থাকতে চায় না, তারা চায় পুরো সমাজটিই যেন ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করে। সমাজের প্রান্তিক মানুষের মুখে হাসি ফোটানোও আমাদের ঈদের আনন্দের অংশ হতে পারে। 

শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিতে ঈদ: ছুটির বাইরেও কিছু বেশি 

এই ভাবনাগুলো থেকেই পরিষ্কার, ঈদ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু ছুটি নয়। এটি এমন একটি সময়, যা জীবনের গভীরতর উপলব্ধির সুযোগ এনে দেয়। যেখানে তারা নিজেকে ফিরে দেখতে পারে, পরিবারকে সময় দিতে পারে, আর সমাজের জন্য কিছু ভাবতে শেখে। 

শুধু নিজের আনন্দ নয়, ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত আছে অন্যকে খুশি করার মধ্যে। হয়তো নতুন জামা নয়, কিন্তু একটি সহানুভূতির হাসি, হয়তো দামি খাবার নয়, কিন্তু কারও সঙ্গে একমুঠো ভাগাভাগি এসবই হয়ে উঠতে পারে ঈদের প্রকৃত বার্তা। 

শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ফুটে ওঠা এসব ভাবনা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আত্মিক সংযোগ, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সাম্যের এক মহামঞ্চ।

জাককানইবির শিক্ষার্থীদের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই ঈদের এক সম্পূর্ণ রূপ যেখানে আছে ক্লান্ত জীবনের বিরতি, শিকড়ে ফেরার আকুতি, সম্পর্কের পুনঃআবিষ্কার, এবং এক গভীর মানবিকতার ছোঁয়া। 

এই ঈদ হোক শুধু আনন্দের নয়, হোক দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতার এক মহোৎসব। শিক্ষার্থীদের ভাবনাতেই যেন প্রতিফলিত হয় আগামী দিনের একটি মানবিক ও সমতার সমাজ।

ইএইচ