Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪,

ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই কাচারিঘর

ফরিদপুর প্রতিনিধি:

ফরিদপুর প্রতিনিধি:

এপ্রিল ২১, ২০২৪, ১০:৫৯ এএম


ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই কাচারিঘর

বৃটিশ ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাংলার অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিদের ঐতিহ্যের প্রতীক ছিলো কাচারিঘর। কিছু সংখ্যক মানুষ কাচারিঘর নির্মাণে টিন ব্যবহার করলেও অধিকাংশ ব্যবহার করতেন ছন। তখনকার দিনে ছনের ঘর ছিল আরামদায়ক। কাচারি ঘরগুলো মূল বাড়ি থেকে একটু বাইরে তৈরি করা হতো। দূরত্বটা এতটুকু রাখা হতো যাতে করে বাড়ির মহিলাদের কন্ঠ কাচারি ঘর পর্যন্ত না পৌঁছায়। অথবা কাচারি ঘরের কথাগুলো অন্দর মহলে না যায়।

এমনই একটা ঐতিহ্যবাহী কাচারিঘরের সন্ধান মিলেছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের গুনবহা গ্রামের কাজী বাড়িতে। শতবর্ষী এ কাচারিঘরটি কালের আবর্তনে জৌলুস হারালেও তার আছে গৌরবময় ইতিহাস। আছে নানা লোক কাহিনি। এই কাচারিঘরে এসেছেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম,পল্লী কবি জসিমউদদীন, শেরেবাংলা এ,কে ফজলুল হক, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী, কবি হুমায়ুন কবীর, চৌধুরী ইউসুফ আলী মোহন মিয়া। তবে সবচেয়ে বেশি এই বাড়িতে বা এই কাচারিঘরে যিনি এসেছেন, তিনি হলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

এছাড়াও ঐতিহাসিক কাচারিঘরে এসেছেন, বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাল প্রধান কৌশলী আব্দুস সালাম খান, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ডাক ও তার প্রতিমন্ত্রী কে,এম, ওবায়দুর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষা মন্ত্রী এম,এ মজিদ খান, বর্তমান সরকারের বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক,বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমত কাদীর গামা,তাঁর বড় ভাই বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ফরিদপুর ১০ নং আসনের সংসদ সদস্য নুরুল কাদীর জুনু, একই সংসদের ৪ নং আসনের এমপি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন, প্রখ্যাত অভিনেতা অমল বোসের ছোট বেলার অভিনয়ের রিহার্সালের সূতিকাগার ছিল এই কাচারিঘর।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাত্রে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যা হওয়ার পর আত্মগোপনে থাকার অনেকটা সময় এই কাচারিঘরে কেটেছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুর রহমান, বিএনএম এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহ মো. আবু জাফরও ছাত্র জীবনে এই কাচারিঘরে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, পঞ্চাশের দশকেও এ অঞ্চলটা ছিল বৃহত্তর যশোর জেলার অন্তর্গত। গুনবহা কাজী বাড়ির সন্তান কাজী আব্দুল হক ছিলেন একাধারে কয়েকবারের নির্বাচিত জেলা চেয়ারম্যান ও কংগ্রেস দলের জেলা সভাপতি। কাজী আব্দুল হক সাহেবের বড় ভাই কাজী আব্দুল মজিদের উদ্যোগে বাড়িতে একটা ছনের আটচালা কাচারিঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কথিত আছে,কাচারি ঘরটি তৈরি করতে কয়েক সেট মিস্ত্রি তিনি বদল করেছিলেন, শুধু দিনের দিন কাজ শুরু করার কারণে।

সর্বশেষ একদল মিস্ত্রি তাদের অস্ত্রপাতি ধার দিতে সময় নিয়েছিলেন ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ ৪২ দিন। বাঁশের সাজ, বেতের বাঁধন,শাল-সুন্দরীর খুঁটি আর ছনের ছাউনিতে কাচারিঘর দাড় করাতে সময় লাগে কয়েক বছর। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে শত শত লোক আসতো কাচারিঘর নির্মাণের কাজ দেখতে।

সরেজমিন দেখা যায়, শতবর্ষী সেই কাচারিঘরটি আজ আর নেই। ছন এবং কারিগরের অভাবে আটচালা কাচারিঘরটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে বহু স্মৃতিময় ভিটায় প্রায় ৪০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে টিনের প্রতীকী কাচারিঘর। সেই সময়ের কিছু সাল কাঠের খুঁটি, কাঠ ও লোহার রড এখনও স্মৃতি হিসেবে রয়েছে। কাচারিঘরটিতে এখন আর আড্ডা, গল্পগুজব,বৈঠক কিছুই হয় না। জমির ফসল ও পরিবারের বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা হয়। যা অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পুরোনো স্মৃতি বুকে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই কাচারিঘরের জৌলুস ও উপযোগিতা না থাকলেও ছনের কাচারিঘরে এসেছেন, ব্রিটিশ ভারতসহ দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ।

স্থানীয় ও পরিবার সুত্রে জানাগেছে, আগেকার দিনে মুসলিম পরিবারের কাচারি ঘর হিন্দু সমাজে বৈঠকখানা থাকতো। এখানেই চলতো সামাজিক সালিশ-দরবার, বিয়ের অনুষ্ঠান, পথচারীদের রাত্রি যাপন, এমন কী গ্রামবাসী এসব জায়গায় বসেই আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ের মনোনয়ন বা ভোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। আজকে যেমন ঘরে ঘরে টিভি বা হাতে হাতে বিনোদন মাধ্যম, দেশ স্বাধীনের পূর্ব থেকে স্বাধীনতাত্তোর আশির দশক পর্যন্ত গ্রামের মানুষের বিনোদনের অন্যতম স্থান ছিল গ্রামের বিত্তবানদের বাড়ির কাচারিঘর। ওখানে পুঁথিপাঠ, লুডু, বাঘবন্দি সহ নানা খেলায় সময় পার করতো গ্রামের একশ্রেণির বেকার এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা। বাড়ির ভিতর থেকে তাদের জন্যে আসতো নাস্তা। খাবার সময়ে খাবারও আসতো মাঝে মধ্যে। নব্বইয়ের দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আকাশ সংস্কৃতির উন্নয়নের সাথে সাথে কাচারিঘরের সংস্কৃতি মানুষের ড্রইংরুমে ঢুকে গেছে।

ওই বাড়ির সন্তান কবি ও সাংবাদিক কাজী হাসান ফিরোজ বলেন, কাচারিঘরটি ছিল আমাদের শৈশবের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। গরমের রাতে মনে হয়েছে গ্রামটাই কাচারিঘরে উঠে এসেছে। আমাদের শৈশবে আব্দুর রহমান,শাহ মো. আবুজাফরের মত নেতাদের কাছের থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আব্দুর রহমান ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো। ন্যাপ ভাসানী নেতা অ্যাডভোকেট মিঞা সাদেকুর রহমানতো ছিলেন একই গ্রামের সন্তান, এবং কাজী আব্দুল হক সাহেব ছিলেন তাঁর হাই স্কুলের শিক্ষক।

তিনি বলেন, আমার ছেলে বেলায় ৭০ এর নির্বাচনে দেখেছি আব্দুস সালাম খান সাহেব ভোট চাইতে এসেছেন। তিনি ওই বাড়ির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। তিনি এলে কাচারিঘর থেকে বাড়ির দুই সন্তান আবু দায়েন কাজল(জিয়া ও এরশাদ বিরোধী  আন্দোলনের পুরোধা ছাত্রনেতা ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সরকারি ইয়াছিন কলেজের ভিপি), কাজী ইমদাদুল হক লুলু(জিয়া ও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতা, বোয়ালমারী সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি, বোয়ালমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি) সুর তুলতেন, ইলিশ মাছের ত্রিশ কাঁটা, বোয়ালমাছের দাড়ি, সালাম পাগলা চাকর খাটে শেখ সাহেবের বাড়ি। আমরা তখন অনেক ছোট হলেও তাঁদের সাথে সুর মিলাতাম।

এ ব্যাপারে গুনবহা কাজী বাড়ির সন্তান এনজিও ব্যক্তিত্ব, সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট কমিটি (এসডিসি)‍‍`র নির্বাহী পরিচালক কাজী আশরাফুল হাসান বলেন, শত বছরের পুরোনো কাচারি ঘরটি এখন আর নেই। তবে এখন যে কাচারি ঘরটি আছে তার বয়সও প্রায় ৪০ বছরের মতো। ছোটকালে পুরোনো কাচারি ঘরটি আমি নিজে দেখেছি তখন আমার বয়স প্রায় ২০ বছর। সেই কাচারি ঘরের কিছু স্মৃতি চিহ্ন এখনও আছে। তবে ওই সময়ের কিছু সাদাকালো ছবি থাকলেও এখন আর নেই, নষ্ট হয়ে গেছে।

ঘোষপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীন আহমেদ জানান,১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাগুরা মহকুমার একটি আসনের আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন এম,এ খালেক(সাবেক মন্ত্রী), তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যুক্তফ্রন্টের মৌলভি কফিল উদ্দিন(কংগ্রেসের ভলান্টিয়ার)।

সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান(মুজিব ভাই) টুঙ্গিপাড়া থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে গুনবহা থেকে কাজী মুজিবুর রহমানকে সাথে করে ময়না ইউনিয়নের ঠাকুরপুর বাজারে জনসভা করেন। সেখান থেকে দলীয় নির্বাচনী প্রোগ্রামে যোগ দিতে বাইসাইকেল চালিয়ে যান কামারখালী। কামারখালী যাত্রায় সহযোগী ছিলাম আমি এবং কাজী মজিবর রহমান(নবু কাজী)। খালেক সাহেব ১৮৮ ভোটে জয়লাভ করেন।" এম, এ খালেক সাহেব এই কাচারিঘরে এসেছেন। মৌলভী কফিল উদ্দিন সাহেবের এটা ছিল ফুফা শ্বশুরবাড়ি। অপ্রিয় হলেও সত্য, কফিলউদ্দিন সাহেবের ফুফা শ্বশুর বাড়ির কেউ তাঁর সমর্থক ছিলেননা। তাঁরা করতেন আওয়ামী মুসলিম লীগ।

এ ব্যাপারে সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর বলেন, এই বাড়িতে এবং কাচারি ঘরটিতে মহান ব্যক্তিদের আগমন ঘটেছে। আমি নিজেও কাচারি ঘরটিতে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমার অনেক স্মৃতিও রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী,ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাত্রে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যা হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকার অনেকটা সময় এই কাচারিঘরে কেটেছে।

বিআরইউ

Link copied!